
বালফোর ঘোষণা: দখলদারির প্রথম ইশারা
১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বালফোর জায়নবাদী নেতা রথচাইল্ডকে চিঠি লিখে জানান, ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য রাষ্ট্র গঠনে তারা সহায়তা করবে।
এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্ভোগের সূচনা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে অটোমান সাম্রাজ্য থেকে ফিলিস্তিন চলে যায় ব্রিটিশ শাসনের অধীনে এবং ১৯২০–৪৮ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে এক পরিকল্পিত দখলনীতি।
ব্রিটিশ আমলে অভিবাসন ও সন্ত্রাস
ব্রিটিশ শাসনের সময় আরব সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনিদের পদ্ধতিগতভাবে বঞ্চিত করা হয়। ইহুদিদের জন্য অভিবাসনের পথ খুলে দেওয়া হয় এবং গড়ে তোলা হয় আধা-সামরিক বাহিনী—হাগানাহ। পরে আরও দুইটি সন্ত্রাসী সংগঠন (ইরগুন ও স্টার্ন) গড়ে ওঠে, যারা ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য নৃশংস কর্মকাণ্ড চালায়।
১৯৩৭ সালে ব্রিটিশদের পিল কমিশন ফিলিস্তিনকে ভাগ করে ছোট একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেয়। আরবরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও জায়নবাদীরা এটিকে ভবিষ্যতের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ হিসেবে নেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ইউরোপের দায়
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে ইউরোপে নাৎসি বাহিনীর হাতে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি নিহত হয়। এই গণহত্যা (হলোকাস্ট) শেষ পর্যন্ত ইসরায়েল গঠনের প্রধান অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অথচ ইউরোপের অপরাধের দায় চাপানো হয় ফিলিস্তিনিদের ওপর।
১৯৪৮: আল নাকবা ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা
১৯৪৮ সালের ১০ মার্চ “প্ল্যান ডি” নামে একটি পরিকল্পনার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হয়।
১৪ মে, ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করেন ডেভিড বেন গুরিয়ান। পরদিনই যুক্তরাষ্ট্র তা স্বীকৃতি দেয়।
এই ঘোষণার ফলে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি রাতারাতি নিজ ভূমি ছেড়ে পালিয়ে শরণার্থী হয়ে যায়। এই মানবিক বিপর্যয়কে বলা হয় আল নাকবা (বিপর্যয়), যা এখনো প্রতি ১৫ মে বিশ্বজুড়ে স্মরণ করা হয়।
আরব প্রতিরোধের ব্যর্থতা
ইসরায়েল ঘোষণার পর পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলো সেনা পাঠালেও সমন্বয়হীনতা ও গোপন রাজনৈতিক সমঝোতার কারণে তারা ইসরায়েলি বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে পারেনি। ফলে ইসরায়েল ক্রমে নিজেদের দখলদারি জোরদার করে এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের আর ফিরে যেতে দেয়নি।
১৯৬৭ সালের দখল: দখলদারির আরেক অধ্যায়
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল দখল করে নেয় পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর ও গোলান উপত্যকা। এর ফলে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্রের স্বপ্ন আরও দূরে সরে যায়।
দমন-পীড়ন ও চলমান সংকট
আজও ফিলিস্তিনি জনগণ দখলদারির যন্ত্রণা ভোগ করছে। পশ্চিমা বিশ্বের সরাসরি সহায়তায় ইসরায়েল রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী এবং প্রযুক্তি-নির্ভর সমাজ, কিন্তু শান্তি তাদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে।
ইতিহাসবিদদের প্রতিবাদ
এখন খোদ ইসরায়েলের ভেতর থেকেই উঠে আসছে প্রতিবাদ। বিশিষ্ট গবেষক বেনি মরিস, ইলান পেপে, শলমো স্যান্ড প্রমুখ বারবার স্বীকার করেছেন—ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল নিপীড়ন ও দখলদারির মাধ্যমে।
শেষ কথা
শতবর্ষ পেরিয়েও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট সমাধান হয়নি।
বিশ্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিলিস্তিনিদের দখল করা ভূমি ফিরিয়ে না দিলে, নিপীড়নের অবসান ঘটিয়ে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না দিলে এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ইতি ঘটবে না।
“ইহুদি গণহত্যার দায় ইউরোপের, কিন্তু ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে ফিলিস্তিনিরা।” — এক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক
এম আর এম – ০৬১৭ , Signalbd.com