বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে। ১৯৭২ সাল থেকে প্রায় সাতবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তন হলেও এবার শিক্ষাক্রম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থার বিশ্লেষণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে আরও জোরদার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে ১৬টি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য যুগোপযোগী, নৈতিক ও মানবিক শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কাজ চলছে। ২০২৭ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিক্ষা প্রশাসন গঠন করছে কাঠামো, যা দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও মানসিকতা উন্নয়নে সহায়ক হবে।
শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের ইতিবৃত্ত
বাংলাদেশে শিক্ষাক্রমের ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৭২ সাল থেকে সাতবার শিক্ষাক্রম বদলানো হয়েছে। ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছিলো — মুখস্থ শিক্ষার বদলে সৃজনশীল শিক্ষার ওপর জোর দেয়া হয়। এরপর ২০২১ সালে আরও আধুনিক শিক্ষাক্রম চালু হয়, যাকে অনেকেই প্রশংসা করলেও এর কিছু দুর্বলতাও দেখা দেয়। বিশেষ করে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ না খাওয়ায় সে শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবিতে আন্দোলনও হয়েছিল।
২০১২ সালের সৃজনশীল শিক্ষাক্রম পুনরায় চালু হলেও সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে ২০২৭ সাল থেকে আরও নৈতিক ও মানবিক শিক্ষাক্রম চালু করার। এ কাজের অংশ হিসেবে ১৬টি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
১৬টি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল দিক
বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নে বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত বিবেচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশগুলো হলো:
- অস্ট্রেলিয়া: বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষার পদ্ধতি ও মূল্যায়ন ভিন্ন হলেও সাধারণত ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষায় জোর দেয়া হয়। শিক্ষার্থীরা সংখ্যাতত্ত্ব, প্রযুক্তি, নীতি, মানবিক বিষয় ও সৃজনশীল চিন্তায় সমানভাবে দক্ষ হয়।
- যুক্তরাষ্ট্র: স্কুলগুলো শিক্ষাদানে স্বাধীন, শিক্ষকরা দক্ষতা ও অনুসন্ধানভিত্তিক শিক্ষাকে প্রধান্য দেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে দলগত কাজ ও সমালোচনামূলক চিন্তা বিকাশের সুযোগ বাড়ে।
- ফিনল্যান্ড: পৃথিবীর অন্যতম সুখী দেশ হিসেবে পরিচিত, এখানে জীবনমুখী সমস্যা সমাধান এবং অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষায় গুরুত্ব দেয়া হয়। দ্বাদশ শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষা হয়।
- চীন: বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনে ভাষা, কারিগরি শিক্ষা, গণিত, নৈতিক ও রাজনৈতিক শিক্ষায় গুরুত্ব দেয়া হয়। সেখানে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে সমালোচনামূলক চিন্তা ও উদ্ভাবনী শিক্ষা প্রচারিত হয়।
বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ
এই উন্নত শিক্ষাব্যবস্থাগুলো বাংলাদেশে চালু করা সহজ নয়। দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, শিক্ষক ও প্রশিক্ষকের ঘাটতি, এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা শিক্ষার মান উন্নয়নে বড় বাধা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বিশেষজ্ঞ ড. মুহাম্মদ জাইর আল ফারুকী বলেন, “আমাদের ক্লাসরুমের পরিবেশ এবং শিক্ষার চর্চায় অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এজন্য শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা ও নিষ্ঠার বিকাশ অপরিহার্য।”
অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর শিক্ষাবিষয়ক ভিন্ন মতাদর্শও শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক রবিউল কবির চৌধুরী জানিয়েছেন, “শিক্ষাক্রম নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সমন্বিত কাঠামো তৈরির চেষ্টা করা হবে, যাতে দলগুলোর মতামত প্রতিফলিত হয় এবং ভবিষ্যতের সরকার সেটি বাস্তবায়ন করতে পারে।”
শিক্ষাবিদদের পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, “কারিকুলাম পরিবর্তনের আগে আমাদের সংবিধান ও শিক্ষানীতি সংশোধন প্রয়োজন। বর্তমান শিক্ষানীতি পুরনো ও অসঙ্গতিপূর্ণ, তাই তার ওপর ভিত্তি করে নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি করা সম্ভব নয়।”
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, “একবারেই শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তবে আমরা ইতিমধ্যেই এনসিটিবিতে একাধিক বৈঠক করেছি এবং কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। নতুন শিক্ষাক্রম যেন শুধু নোটবই ও কোচিং বাণিজ্যকে উৎসাহিত না করে, এমন শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন।”
সামগ্রিক মূল্যায়ন ও প্রত্যাশা
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে আন্তর্জাতিক শিক্ষার দৃষ্টান্ত গ্রহণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত অন্তর্ভুক্তি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, মানবিক মূল্যবোধ ও প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জনের জন্য এমন শিক্ষাক্রম জরুরি।
তবে দেশের বাস্তবতা, শিক্ষক সম্পদ ও অবকাঠামো উন্নয়নে যথেষ্ট বিনিয়োগ না হলে সফলতা আসবে না। এজন্য শুধু শিক্ষাক্রম পরিবর্তন নয়, সার্বিক শিক্ষানীতি ও প্রশাসনিক সংস্কারও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তন একটি সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক ও মানবিক করার লক্ষ্য সফল করতে সরকার, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য শুধুমাত্র পঠন-পাঠন নয়, মানুষের চরিত্র গঠন ও সমাজের উন্নয়ন — এ দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন শিক্ষাক্রম হবে বাংলাদেশের শিক্ষার নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সূচনা।



