জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার শ্রীকর্ণদীঘি উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর ফলাফল ঘিরে তৈরি হয়েছে তুমুল আলোচনার ঝড়। এক বিষয়ের পরীক্ষায় অংশ নিয়েও ফলাফলে দেখানো হয়েছে দুই বিষয়ে ফেল! ঘটনাটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ছাত্র, অভিভাবক, এমনকি স্থানীয় শিক্ষকরাও।
২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর এই ঘটনা সামনে আসে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর দাবি, তিনি কেবল গণিত বিষয়ে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। অথচ প্রকাশিত রেজাল্টে তাকে গণিতের পাশাপাশি কৃষি বিষয়েও ফেল দেখানো হয়েছে — যা ছিলই না তার পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত।
কে এই শিক্ষার্থী? কী ঘটেছিল?
শিক্ষার্থীর নাম জিৎ চন্দ্র মহন্ত। তিনি ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে শ্রীকর্ণদীঘি উচ্চ বিদ্যালয়ের কারিগরি শাখায় ফার্ম মেশিনারি ট্রেডে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় তিনি ১৪টি বিষয়ের মধ্যে কেবল গণিতে অকৃতকার্য হন।
এরপর এক বছর কঠোর অধ্যবসায়ের পর ২০২৫ সালে তিনি শুধুমাত্র গণিত বিষয়ে পুনঃপরীক্ষায় অংশ নেন। কিন্তু ২০২৫ সালের এসএসসি রেজাল্ট প্রকাশের পর দেখা যায়, ফলাফলে তিনি গণিতের পাশাপাশি কৃষি বিষয়েও ফেল করেছেন।
জিতের ভাষায়, “আমি তো কেবল গণিতের পরীক্ষায় বসেছিলাম। কৃষি বিষয় কখনও পরীক্ষার অংশ ছিল না। অথচ ফলাফলে দেখছি কৃষিতেও ফেল দেখানো হয়েছে। মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছি।”
বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী বলছে?
বিদ্যালয়ের কারিগরি শাখার সহকারী শিক্ষক ওমর ফারুক বলেন, “বোর্ডের কোনো কারিগরি ত্রুটির কারণে এমন ফলাফল আসতে পারে। নম্বরপত্র হাতে পেলে বিস্তারিত বোঝা যাবে। আশা করছি, চূড়ান্ত মার্কশিটে সমস্যাটি সমাধান হয়ে যাবে।”
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রুহুল আমিন বলেন, “আমি বিষয়টি শুনেছি এবং খোঁজ নিচ্ছি। একই রকম সমস্যার মুখোমুখি আমাদের আরও দুইজন শিক্ষার্থী হয়েছে। কৃষি ‘ফোর্থ সাবজেক্ট’ হওয়ায় মূল ফলাফলে ফেল দেখানোর কথা নয়। তবে গণিতে পাস করলেই মোট ফলাফলে পাস দেখানোর কথা।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে বোর্ড কর্তৃপক্ষকে জানাবো এবং দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করব।”
বোর্ডের ভুল না কি অন্য কিছু?
এ ধরনের ভুল ফলাফল শুধু শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নয়, গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার ওপরই প্রশ্ন তোলে। ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে এমন ‘সফটওয়্যার গ্লিচ’ বা কারিগরি ত্রুটি আগেও দেখা গেছে। বিশেষ করে চতুর্থ বিষয় সংক্রান্ত জটিলতা অনেক সময় মূল ফলাফলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
বোর্ডের কেউ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য না করলেও, শিক্ষা প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, চূড়ান্ত মার্কশিটের আগে ‘অন্তর্বর্তী ফলাফল’ প্রকাশে কিছু কারিগরি সমস্যা হতে পারে। তবে পরীক্ষার্থী যদি একটি বিষয়ে পরীক্ষা দেয়, তবে অন্য বিষয়ের ফল দেখানো কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।
পূর্বের ঘটনার নজির কী বলে?
এটি প্রথম ঘটনা নয়। এর আগেও বিভিন্ন বোর্ডে চতুর্থ বিষয় ভুল গণনায় বা সাবজেক্ট কোড বিভ্রান্তিতে পরীক্ষার্থীদের ফলাফলে এমন গড়বড় দেখা গেছে। শিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে এ ধরনের ফল বিভ্রান্তি নিয়ে প্রায় ১,২০০-এর বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
অনেক সময় সাবজেক্ট কোড ভুল এন্ট্রি হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীর মূল পরীক্ষার তালিকায় না থাকা বিষয়েও ফেল দেখানো হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব সমস্যার সমাধান হয়েছে পুনরায় মার্কশিট ইস্যুর মাধ্যমে।
প্রভাবিত শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কীভাবে বদলাতে পারে?
একটি পরীক্ষার ভুল ফলাফল শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষা, ভর্তি প্রক্রিয়া এমনকি আত্মবিশ্বাসেও বড় প্রভাব ফেলে। জিতের মতো অনিয়মিত পরীক্ষার্থী যারা শুধু একটি বিষয়ের জন্য পরিশ্রম করেছেন, তাদের জন্য এ ধরনের বিভ্রান্তি সত্যিই হতাশাজনক।
এছাড়া অভিভাবকরাও এমন ঘটনাকে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টি করছে বলে মন্তব্য করেছেন।
কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
শিক্ষাবোর্ডের উচিত হবে, ফলাফল প্রকাশের আগে চূড়ান্ত যাচাই প্রক্রিয়াকে আরো শক্তিশালী করা। এক্ষেত্রে অনলাইন ফলাফল প্রকাশের সফটওয়্যার আরও উন্নত করা, এবং প্রতিটি প্রবেশপত্র অনুযায়ী ফল যাচাই করার ব্যবস্থা রাখা জরুরি।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য একাধিক অভিযোগ গ্রহণ হেল্পডেস্ক খোলা এবং দ্রুত সমস্যার সমাধান করার প্রক্রিয়া তৈরি করাও সময়ের দাবি।
সারসংক্ষেপ
জিতের মতো শিক্ষার্থীরা দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল টিকিয়ে রাখতে হলে এমন কারিগরি ত্রুটি থেকে শিক্ষা নিতে হবে শিক্ষা প্রশাসনকে। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা যেন ফলাফলের অপেক্ষায় না থেকে অনিশ্চয়তায় না ভোগে — সে দায়িত্ব নিতে হবে বোর্ড কর্তৃপক্ষকে।
“এক বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে দুই বিষয়ে ফেল — এটি শুধু একটি ত্রুটি নয়, একটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি।”
এম আর এম – ০২৯৮, Signalbd.com



