শিক্ষা

চোয়ালে কলম চেপে এসএসসিতে জিপিএ-৫

Advertisement

বাংলাদেশের শিক্ষা ও মানবজীবনের অনুপ্রেরণার এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছেন যশোরের মনিরামপুর উপজেলার লিতুন জিরা। জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে চলা এই সাহসী কিশোরী চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ অর্জন করে দেখিয়েছেন—অসাধারণ সাধনার শক্তি কোথায় শেষ হয়, তার জীবন্ত উদাহরণ তিনি।

লিতুন জিরার জীবনের গল্প: প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে শিক্ষার আলোকময় পথ

লিতুন জিরার জন্ম ২০০৮ সালের ২৫ জুন যশোরের মনিরামপুর উপজেলার শেখপাড়া খানপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান ও জাহানারা খাতুন দম্পতির পরিবারে। জন্ম থেকেই তার দুই পা এবং দুই হাত নেই। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও লিতুন নিজের দৃঢ় সংকল্পের ধারা থামেনি।

লিখতে শিখেছেন অদ্ভুত এক পদ্ধতিতে—ডান বাহুর মাথা এবং চোয়ালের সঙ্গে কলম চেপে ধরে। ছোটবেলা থেকে নিজেই চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন টেবিলে বা স্লেটে কলম দিয়ে লিখতে। এই ব্যতিক্রমী চেষ্টা তাকে এনে দিয়েছে শিক্ষার জগতে অনন্য সাফল্য।

পরিবারের অকুণ্ঠ সমর্থন: লিতুনের সফলতার অন্যতম মূলকথা

লিতুনের বাবা, হাবিবুর রহমান, যিনি যশোর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এ আর মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক, এবং মা জাহানারা খাতুন, গৃহিণী, যাদের অবিচল সমর্থন ও ভালোবাসার ছায়া লিতুনকে শক্তি দিয়েছে কঠোর পরিশ্রম করতে।

প্রতিদিন সকালে মা তাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে মোটরসাইকেলে করে স্কুলে পৌঁছে দিতেন। স্কুল থেকে ফিরে আবারও মা তাকে বাসায় নিয়ে আসতেন। তার দাদি টিফিন সময় স্কুলে গিয়ে খাবার খাইয়ে আসতেন। স্কুল ও বাড়ির দূরত্ব প্রায় আড়াই কিলোমিটার হলেও, পরিবার ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছিল লিতুনের শিক্ষাজীবনের প্রতিটি ধাপে।

অসাধারণ ফলাফল: এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫

২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে লিতুন জিরা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। একই ফলাফল তিনি পিইসিতে অর্জন করেছিলেন। এই সাফল্য শুধু তার নয়, তার পরিবার, শিক্ষক, এবং বন্ধুদের কষ্ট ও সহযোগিতার প্রতিফলন।

লিতুন জিরা নিজেই বলেছেন, “পরীক্ষার ফলাফলে আমি খুব খুশি। মা-বাবা, স্কুলের স্যার, আর বন্ধুদের সহযোগিতা ছাড়া এটা সম্ভব হতো না। আমি ভালো মানুষ হতে চাই, লেখাপড়া শিখে চিকিৎসক হিসেবে মানুষের সেবা করতে চাই।”

শিক্ষকের প্রশংসা ও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন

গোপালপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ রেজাউল করিম বলেন, “লিতুনের লেখা স্পষ্ট এবং খুব দৃষ্টিনন্দন। খুব দ্রুত লিখতে পারে। সে ভালো ছবি আঁকে এবং গানও গায়। তার ইচ্ছাশক্তি তাকে ভবিষ্যতে আরও বড় সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দেবে। আমরা তার জন্য গর্বিত।”

প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াই ও সাফল্যের অনুপ্রেরণা

লিতুন জিরার গল্প আমাদের শিক্ষা দেয় যে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কখনোই মনোবল ও স্বপ্নের পথে বাধা হতে পারে না। সঠিক পথপ্রদর্শক, পরিবারিক মমতা, এবং নিজের অদম্য চেষ্টা থাকলে মানুষ যে কোনো অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে।

চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণের পথে লিতুন

লিতুনের লক্ষ্য বড়—বড় হয়ে চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করা। তার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে এখন থেকেই পরিশ্রমে নিয়োজিত। তার সাফল্যের পেছনে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবদানের পাশাপাশি সমাজের সকলের সহমর্মিতা ও সহযোগিতার প্রয়োজন।

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার প্রসার

লিতুন জিরার সাফল্য আমাদের দেশের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রতি সামাজিক মনোভাব পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তার মতো কষ্টের পথে চলা শিক্ষার্থীদের জন্য উন্নত পরিবেশ, সুযোগ ও সহায়তার গুরুত্ব আরও বেড়েছে।

সরকার ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এনজিওকে এই প্রেরণাদায়ক কাহিনী থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য আরও সুলভ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

কীভাবে লিতুন জিরার এই গল্প অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে?

  • প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন অটল মনোবল ও সঠিক নির্দেশনা।
  • পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অপরিহার্য।
  • শিক্ষায় প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ সহায়তা ও সুযোগ সৃষ্টি জরুরি।
  • সমাজের সকল স্তরে প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহমর্মিতা ও সমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন।

লিতুন জিরার মতো অসংখ্য কাহিনী দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজের পরিবর্তনে শক্তি যোগাবে

লিতুন জিরার জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি যে, ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রমের কাছে প্রতিবন্ধকতা মানেই পরাজয় নয়। সঠিক দিকনির্দেশনা ও মানসিক সমর্থন থাকলে কেউ পিছিয়ে থাকতে পারে না। তার এই অনন্য সাফল্য দেশের শিক্ষা ও প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button