আঞ্চলিক

ঘরে হাঁটুপানি, ভেলায় করে অন্তঃসত্ত্বাকে নেওয়া হলো হাসপাতালে

Advertisement

ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার ঘর ভেঙে হাঁটুপানির জলমগ্ন এলাকা থেকে কলাগাছের ভেলায় করে হাসপাতালে নেওয়া হলো অন্তঃসত্ত্বা কামরুন নাহারকে (২৩)। গত ৯ জুলাই বুধবার দুপুরে শুরু হয় এই অপ্রত্যাশিত যাত্রা, যেখানে বিপদসীমার ওপরে উঠা বন্যার জলে কাটছিল তাঁর জীবন ও সন্তানের নিরাপত্তা।

পানি বন্যায় ফেনীর ফুলগাজীতে জীবনযাত্রার অচলাবস্থা

ফুলগাজী উপজেলার পূর্ব ঘনিয়ামোড়া গ্রামের কামরুন নাহার বাড়ি ছিল সম্পূর্ণ জলমগ্ন। সকাল থেকেই ঘরে পানি উঠতে শুরু করে, যা দ্রুত বাড়তে থাকে। হাঁটুপানিতে বাড়ির দরজা-জানালা ডুবে যায়, ফলে হাঁটাচলাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই সংকটে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন কামরুনের মা ও তাঁর চাচি। অবস্থার জেরে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাকে কলাগাছের ভেলায় তুলে হাসপাতালে নেওয়ার।

ভেলায় হাসপাতালের পথে: মানবতা ও সহযোগিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

দুপুরের দিকে ভেলাটি বুকসমান পানির মধ্য দিয়ে ফুলগাজী উপজেলা বাজারের কাছে পৌঁছালে আশপাশে কোনো যানবাহন ছিল না। এই কঠিন পরিস্থিতিতে স্থানীয় কিছু স্বেচ্ছাসেবক ও গণমাধ্যমকর্মী বিশেষ করে ইয়াসিন আরাফাত সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এসে একটি পিকআপ ভাড়া করে হাসপাতালের ব্যবস্থা করেন।

ইয়াসিন আরাফাত বলেন, “মুঠোফোনে বন্যার ভিডিও রেকর্ড করতে গিয়ে আমি দেখলাম দুজন বয়স্ক নারী একটি প্রসূতিকে নিয়ে বিপদে পড়ে আছেন। দ্রুত পিকআপ ভাড়া করে তাঁরা হাসপাতালে পৌঁছানো হলো। এতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়েছে।”

হাসপাতালে কামরুন নাহারের স্বাভাবিক প্রসব

ফেনীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে রাত সাড়ে ছটায় কামরুন নাহার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। তাঁর স্বামী মোহাম্মদ ইউসুফ জানিয়েছেন, কোনও অস্ত্রোপচার ছাড়াই সন্তান জন্ম দিয়েছে কামরুন। মা ও শিশু দুজনেই বর্তমানে সুস্থ আছেন।

হাসপাতালের লেবার ওয়ার্ডের নার্স রত্না রানী বসাক জানান, নবজাতককে রাতে বুকের দুধ না পাওয়ায় নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে, তবে মায়ের শারীরিক অবস্থা ভালো।

ইউসুফের উদ্বেগ এবং বন্যার কঠোর বাস্তবতা

কামরুনের স্বামী ইউসুফ, যিনি রাঙামাটির কর্মস্থলে ছিলেন, তার মুঠোফোনে বন্যার খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বন্যার পানির কারণে নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় স্ত্রী ও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও কঠিন হয়ে পড়ে। অবশেষে স্ত্রী প্রসবব্যথায় ভুগতে থাকলে তাঁর শাশুড়ি ও অন্যান্য আত্মীয়রা কলাগাছের ভেলায় করে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান।

বন্যার কারণে স্বাস্থ্যসেবা: ফুলগাজীতে মেডিকেল টিম সক্রিয়

ফেনীর সিভিল সার্জন মোহাম্মাদ রুবাইয়াত বিন করিম জানিয়েছেন, বন্যাকবলিত এলাকায় রোগীদের চিকিৎসার জন্য ফুলগাজী সহ সব উপজেলায় মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। তারা বন্যা চলাকালীন ও পরবর্তী সময়েও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন যাতে জরুরি চিকিৎসা সেবা সুষ্ঠুভাবে পৌঁছায়।

বন্যা পরিস্থিতি ও সরকারের তৎপরতা

ফেনীর দুটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে বইছে, যার ফলে ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া, ফেনী সদরসহ বেশ কিছু এলাকায় প্লাবনের ভয় রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো সক্রিয়ভাবে ত্রাণ ও উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে। আগামী কয়েক দিনে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি আশা করা হচ্ছে।

মানবতার উদাহরণ: বিপদের মাঝে সহযোগিতা

ফুলগাজীর এই ঘটনা শুধু বন্যার করুণ চিত্রই তুলে ধরেনি, বরং সমাজের মধ্যে মানুষের সহযোগিতা ও মানবিকতাও ফুটিয়ে তুলেছে। ঘর ভেঙে হাঁটুপানির মধ্যে কলাগাছের ভেলায় একটি প্রাণ সংরক্ষণের জন্য সহায়তা করার যে দৃশ্য ফুটে উঠেছে, তা বাংলাদেশের বন্যা ব্যবস্থাপনায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত।


ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার পূর্ব ঘনিয়ামোড়া এলাকায় বন্যার পানিতে ডুবে থাকা একটি পরিবারের অন্তঃসত্ত্বা কামরুন নাহারকে কলাগাছের ভেলায় করে ঝুঁকিপূর্ণ পথে হাসপাতালে নেওয়া হয়। স্থানীয় সহযোগিতা ও গণমাধ্যমের ভূমিকার মাধ্যমে দ্রুত পিকআপ ভাড়া করে হাসপাতালে পৌঁছে তিনি স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করেন। মা ও নবজাতক উভয়েই সুস্থ আছেন। বন্যার এই কঠিন সময়ে ফুলগাজীসহ ফেনীর বিভিন্ন এলাকায় মেডিকেল টিম কাজ চালিয়ে যাচ্ছে

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button