কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি বিশ্বজুড়ে যেমন বিপ্লব ঘটাচ্ছে, তেমনি এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, চ্যাটজিপিটির মতো এআই সহকারী ব্যবহারে মানুষের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যেতে পারে।
চ্যাটজিপিটির জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার
২০২২ সালের নভেম্বরে ওপেনএআই চ্যাটজিপিটি উন্মুক্ত করার পর থেকেই এটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এক মুহূর্তে কবিতা লিখে দেওয়া, রেসিপি তৈরি, জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধান থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসাইনমেন্ট বা রিপোর্ট তৈরির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে এই প্রযুক্তিকে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এবং শিক্ষার্থীরা এর সুবিধা নিচ্ছেন সবচেয়ে বেশি।
তবে সহজে উত্তর পাওয়া, কাজ কম করা কিংবা সময় বাঁচানোর সুবিধার পেছনে লুকিয়ে রয়েছে এক অদৃশ্য বিপদ—মস্তিষ্কের অলসতা।
গবেষণার প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমআইটি (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) সম্প্রতি একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে, যার নাম “Your Brain on ChatGPT”। এতে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে, নিয়মিত এআই ব্যবহার করলে মস্তিষ্ক কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় এবং এতে কেমন প্রভাব পড়ে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতায়।
চার মাস ধরে পরিচালিত এই গবেষণায় অংশ নেন ৫৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি। তাদের তিনটি দলে ভাগ করা হয়—
- ব্রেইন অনলি গ্রুপ (নিজের চিন্তা ব্যবহার করে লেখা),
- সার্চ ইঞ্জিন গ্রুপ, এবং
- চ্যাটজিপিটি গ্রুপ।
তাদের সবাইকে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর প্রবন্ধ লেখার কাজ দেওয়া হয়।
কীভাবে পরিচালিত হয়েছে গবেষণা?
প্রতিটি দলের অংশগ্রহণকারীদের লেখার সময় মস্তিষ্কে তড়িৎ সংকেত বা নিউরাল এক্টিভিটি পর্যবেক্ষণ করা হয়। এর পাশাপাশি, তারা যে প্রবন্ধ লিখেছেন, তার মান, ভাষাগত জটিলতা ও মৌলিকতা বিশ্লেষণ করা হয়। মূল লক্ষ্য ছিল—তারা কতটা মনোযোগ দিয়েছেন এবং চিন্তাশক্তি কতটা ব্যবহার করেছেন তা অনুধাবন করা।
গবেষণার চমকপ্রদ ফলাফল
গবেষণায় দেখা যায়, যারা চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে লিখেছেন, তাদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা অন্যদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। শুধু তা-ই নয়, তারা নিজেদের লেখা অনেক অংশই মনে রাখতে পারেননি এবং লেখার প্রতি তাদের সম্পৃক্ততা ছিল খুব কম।
পরবর্তী ধাপে, প্রতিটি দলের অংশগ্রহণকারীদের ভূমিকা বদলানো হয়। যারা আগে মস্তিষ্ক ব্যবহার করেছিলেন, তারা এবার চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেন। আর যারা চ্যাটজিপিটির ওপর নির্ভর করেছিলেন, তারা এবার মস্তিষ্ক দিয়ে প্রবন্ধ লেখেন।
ফলাফল আরো বিস্ময়কর ছিল। চ্যাটজিপিটি থেকে ব্রেইন অনলি গ্রুপে আসা ব্যক্তিরা তাদের কাজ ঠিকমতো সম্পন্ন করতে পারেননি। তাদের মনোযোগ, বিশ্লেষণক্ষমতা ও চিন্তাশক্তি অনেক কমে গিয়েছিল।
‘মেটাকগনিটিভ লেজিনেস’ ও শিক্ষার ভবিষ্যৎ
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি হলো এক ধরনের ‘মেটাকগনিটিভ লেজিনেস’—অর্থাৎ, মনের অলসতা। সহজভাবে কাজ করতে করতে মানুষের মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
গবেষকরা এটিকে একটি বিপদ সংকেত হিসেবে দেখছেন। শিক্ষার্থীরা যদি কম বয়সেই এআই নির্ভর হয়ে পড়ে, তাহলে ভবিষ্যতে তাদের চিন্তা করার ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা ও সৃজনশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ইতিহাসে নজর: ক্যালকুলেটর বনাম এআই
এই আলোচনায় অনেকেই তুলনা করছেন ১৯৭০-এর দশকের ক্যালকুলেটরের সঙ্গে। ক্যালকুলেটর চালু হওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হিসাব করার মানদণ্ড পরিবর্তন করেছিল। ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে কঠিন অঙ্ক করতে দেওয়া হতো, যাতে শিক্ষার্থীরা চিন্তা করেই সমাধান খুঁজে বের করেন।
কিন্তু এখনকার এআই প্রযুক্তি ব্যবহারে শিক্ষাব্যবস্থায় তেমন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। অনেক শিক্ষক এখনো আগের পদ্ধতিতেই মূল্যায়ন করছেন। ফলে শিক্ষার্থীরা চ্যাটজিপিটির মতো টুলের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে থাকেন।
তাহলে কি চ্যাটজিপিটি আমাদের ‘বোকা’ বানিয়ে দিচ্ছে?
এমআইটির গবেষণা একদিকে যেমন চমকে দেওয়ার মতো, অন্যদিকে এতে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। গবেষণার চূড়ান্ত ধাপে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা কম ছিল (মাত্র ১৮ জন)। তাই এটি কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটি বড় পরিসরে নতুন গবেষণার দরজা খুলে দিয়েছে।
কীভাবে ব্যবহার করব এআইকে?
এআইকে পুরোপুরি বাদ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং জানতে হবে কখন, কোথায় এবং কীভাবে এটি ব্যবহার করতে হবে। সাধারণ কাজের জন্য সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু সৃজনশীল বা বিশ্লেষণমূলক কাজে নিজস্ব চিন্তাশক্তিই হবে মূল চালিকা শক্তি।
শিক্ষার্থীদের উচিত হবে প্রথমে নিজের চিন্তা ব্যবহার করে কোনো বিষয় নিয়ে ভাবা এবং গবেষণা করা। পরে, সাপোর্ট টুল হিসেবে চ্যাটজিপিটিকে ব্যবহার করা যেতে পারে।
সংক্ষেপ
চ্যাটজিপিটি আমাদের কাজ সহজ করছে ঠিকই, কিন্তু যদি অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ি, তবে আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। এআইকে ব্যবহার করতেই হবে, তবে তার জন্য প্রয়োজন বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ ভারসাম্য ও সচেতন ব্যবহার।
এম আর এম – ০২২৭, Signalbd.com



