গাজীপুর কিশোর গ্যাং লিডার তেহিম মাতবরের ফাঁকা গুলি ছোড়ার ভিডিও ভাইরাল

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার দক্ষিণ ধনুয়া গ্রামে কিশোর গ্যাং লিডার হিসেবে পরিচিত তেহিম মাতবর (১৮) নামের এক তরুণের পিস্তল হাতে আকাশে ফাঁকা গুলি ছোড়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় এলাকায় তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। শনিবার দুপুর থেকে শুরু হওয়া এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে স্থানীয় জনসাধারণ এবং নেটিজেনদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ এবং সমালোচনা চলছে।

ভিডিওটি দেখে অনেকেই অস্ত্রের উৎস এবং ওই তরুণের পেছনের গ্যাং সংগঠনের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবশ্য জানিয়েছে, অভিযুক্ত তরুণকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলছে।

তেহিম মাতবর: একজন বিতর্কিত কিশোর গ্যাং লিডারের পরিচিতি

তেহিম মাতবর শ্রীপুর উপজেলার দক্ষিণ ধনুয়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি আসাদুজ্জামান মাতবর ওরফে জামাল ডাক্তারের ছেলে। বয়স মাত্র ১৮ বছর হলেও, দীর্ঘদিন ধরে তেহিম স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের নেতা হিসেবে এলাকায় দাপট চালাচ্ছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, তার নেতৃত্বে এলাকায় চাঁদাবাজি, জমি দখল, ছিনতাই, মারামারি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। গার্মেন্টস কেন্দ্রিক এই এলাকায় দূরদূরান্ত থেকে আসা শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

ভাইরাল ভিডিও: ছাদের ওপর পিস্তল হাতে গুলি

ভিডিওটিতে দেখা যায়, একটি বহুতল ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে ফুলহাতা কালো শার্ট পরা তেহিম ডান হাতে পিস্তল উঁচিয়ে আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি ছুড়ছেন। ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে প্রায় তিন মাস আগে, কিন্তু সম্প্রতি এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বিষয়টি নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

এমন কাণ্ড দেখে স্থানীয়রা আতঙ্কিত ও ভীত। অনেকেই সাহস করে তেহিমের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের নির্যাতন এবং অপরাধের কথা প্রকাশ করছেন। স্থানীয়দের ভাষ্যে, তেহিমের দাপটে এলাকার সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার ও নিরাপত্তা হারিয়েছেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ ও প্রশাসনের অবস্থান

৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য গাজী ইসমাইল বলেন, “তেহিম এলাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা। তিনি নিয়মিতভাবে অপরাধ জগতে লিপ্ত। তার ভয় ও দাপটের কারণে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পেত না। এখন যখন তার ফাঁকা গুলি ছোড়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, আশা করি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত তাকে গ্রেপ্তার করবে।”

শ্রীপুর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল বারিক সাংবাদিকদের জানান, “ভিডিওটি প্রায় তিন মাস আগে ধারণ করা হয়েছে। বিষয়টি ঘটার পরপরই আমাদের নজরে এসেছে। অভিযুক্তকে খোঁজা হচ্ছে এবং তার বিস্তারিত তথ্য জানার চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে পুলিশের বিভিন্ন টিম অভিযান চালাচ্ছে। ভিডিওর সত্যতা যাচাই ও প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

কিশোর গ্যাং সমস্যা: গাজীপুরের একটি বড় চ্যালেঞ্জ

গাজীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উপস্থিতি ক্রমেই বেড়ে চলছে, যা স্থানীয়দের জন্য বড় একটি নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শ্রীপুরের মত গার্মেন্টস ও শিল্পাঞ্চলে কিশোর গ্যাংয়ের কারণে চাঁদাবাজি, মারামারি ও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অভিযান চালানো হলেও, অপরাধের মেরুকরণে কিশোর গ্যাংয়ের প্রভাব কমানোতে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে অসংখ্য হতবিহবল কিশোর এসব গ্যাংয়ের প্রলোভনে পড়ে অপরাধের পথে প্রবেশ করছে, যার কারণ সামাজিক অবহেলা, অর্থনৈতিক সংকট ও শিক্ষা হীনতা।

গাজীপুরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা

গাজীপুর শ্রীপুরসহ আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নত করতে স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারকে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। কিশোর গ্যাং, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা নির্মূলের জন্য কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি যুবকদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

স্থানীয়রা দাবী করছেন, শ্রীপুরে পুলিশের উপস্থিতি বৃদ্ধি ও নিয়মিত গোয়েন্দা তৎপরতা চালানো উচিত। এ ছাড়া, সম্প্রদায়ভিত্তিক সচেতনতা কর্মসূচি ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে অপরাধ নির্মূলের কাজ শুরু করা জরুরি।

অপরাধী তরুণদের জন্য পুনর্বাসন ও শিক্ষা: একটি সমাধান

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধুমাত্র কঠোর আইন প্রয়োগ করেই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের মধ্যে যারা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে, তাদের জন্য পুনর্বাসন কার্যক্রম চালু করতে হবে। তাদের জন্য কারিগরি শিক্ষা, মনোবৈজ্ঞানিক পরামর্শ এবং পেশাদার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সমাজে তাদেরকে আবারো গ্রহণযোগ্য করে তোলা গেলে অপরাধের গ্লানি কমানো সম্ভব।

সম্প্রদায়ের ঐক্যই হতে পারে গ্যাং সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি

স্থানীয় জনগণ ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে একত্রিত হয়ে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি পরিবারগুলোকে সচেতন হতে হবে, যাতে কিশোররা অপরাধের পথে না যায়।

গাজীপুর শ্রীপুরে কিশোর গ্যাং লিডার তেহিম মাতবরের ফাঁকা গুলি ছোড়ার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ঘটনা শুধু এক ব্যক্তির অপরাধ নয়, এটি আমাদের সমাজের একটি বড় সংকটের পরিচায়ক। অপরাধ ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত সমাজ গড়তে হলে তরুণদের সঠিক দিকনির্দেশনা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল ভূমিকা নিতে হবে।

গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এই ধরনের কিশোর গ্যাংয়ের নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সচেতন সমাজ গড়ে তোলা অপরিহার্য। তেহিম মাতবরের মতো কিশোরদের অপরাধ থেকে ফিরিয়ে এনে সুশিক্ষিত ও নৈতিক সমাজ গড়ে তোলা দেশ ও জাতির জন্য সময়ের দাবি।