কর্মসংস্থান

সিলিকন ভ্যালিতে চাকরি পেলেন চুয়েটের ইরফান, বেতন বছরে সাড়ে তিন কোটি

চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে ইরফান উদ্দীন ৯ ধাপের কঠিন ইন্টারভিউ পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ এআই কোম্পানি ‘অ্যাস্টেরা ল্যাবস’-এ চাকরি পেয়েছেন। শিক্ষাজীবনে বহু সংগ্রাম আর সাফল্যের গল্প এখন অনুপ্রেরণা সবার জন্য।

এক নজরে পুরো ঘটনা

যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত প্রযুক্তি অঞ্চল সিলিকন ভ্যালিতে চাকরি পেয়েছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)-এর প্রাক্তন শিক্ষার্থী মো. ইরফান উদ্দীন। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাস্টেরা ল্যাবস নামক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রিক্যাল প্রোডাক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। বার্ষিক বেতন ৩.৫ কোটি টাকা, সাথে আছে প্রায় ৩০ লাখ টাকার সাইনিং বোনাস, স্টক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা।

প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আন্তর্জাতিক স্বপ্ন

ইরফান চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের এক প্রান্তিক গ্রামে বেড়ে ওঠেন। স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে তিনি ভর্তি হন ধর্মপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। এখানেই তার প্রতিভার প্রথম উন্মেষ — অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান, এসএসসি ও এইচএসসি দুই পরীক্ষায়ই জিপিএ-৫

এরপর তিনি ভর্তি হন দেশের অন্যতম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় চুয়েটে, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। ২০১৬ সালে স্নাতক শেষ করেন। তবে তখনই শুরু হয় নতুন চ্যালেঞ্জ।

চাকরি পাওয়া ও সংগ্রামের গল্প

স্নাতকের পর দেশে চাকরির জন্য আবেদন করেও দীর্ঘদিন বেকার ছিলেন ইরফান। পরে ওয়ালটন কোম্পানিতে চাকরি পান, যেখানে কাজের মাধ্যমে মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার জন্য ফুল ফান্ডিং স্কলারশিপে ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইয়োমিং-এ। সেখানে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করেন।

চাকরি পাওয়ার পেছনের কৌশল

ইরফান বলেন, “জানুয়ারিতেই চাকরি খোঁজা শুরু করেছিলাম। প্রতিদিন প্রায় ২ ঘণ্টা শুধু চাকরির আবেদনের পেছনে দিতাম। একসময় হতাশ হয়ে পড়লেও হাল ছাড়িনি।”

অ্যাস্টেরা ল্যাবসে চাকরি পেতে তাকে ৯ ধাপে ইন্টারভিউ দিতে হয়। এর মধ্যে ৭টি ইন্টারভিউ ছিল একদিনেই, যা প্রায় ৫ ঘণ্টা ধরে চলে। ইন্টারভিউ দিতে তাকে বারবার ওয়াইয়োমিং থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় যেতে হয়েছে।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাও কাজে লেগেছে। ওয়ালটনের কাজের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাই আমাকে প্রতিযোগিতায় টিকতে সাহায্য করেছে।”

বেতন, সুবিধা ও শর্ত

চাকরির অফার অনুযায়ী, ইরফান বছরে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার মতো বেতন পাচ্ছেন। সঙ্গে আছে প্রায় ৩০ লাখ টাকার সাইনিং বোনাস, শেয়ার, ইনস্যুরেন্সসহ আরও বিভিন্ন সুবিধা। ইরফান জানান, তিনি ১,০০০টির বেশি জায়গায় আবেদন করেছিলেন। একাধিক অফার পাওয়ার পর অ্যাস্টেরা ল্যাবস-কে বেছে নেন।

কম CGPA, কিন্তু স্কলারশিপ পেয়েছেন যেভাবে

চুয়েট থেকে তার সিজিপিএ ছিল ২.৯৮। সাধারণভাবে কম সিজিপিএ-তে স্কলারশিপ পাওয়া কঠিন হলেও, ইরফান GRE পরীক্ষায় ৩৩১ স্কোর করেন এবং একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন। একপর্যায়ে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইয়োমিং থেকে ফুল ফান্ডিং পান।

তিনি বলেন, “আমার রিসার্চ পেপার ছিল না, সিজিপিএ কম — তাই বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে GRE-তে মনোযোগ দিই। এটি ছিল টার্নিং পয়েন্ট।”

এলাকাবাসীর প্রতিক্রিয়া ও গর্ব

ধর্মপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন বলেন, “আমাদের ছাত্র ইরফান আজ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে — গর্বের বিষয়।”

ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “প্রান্তিক অঞ্চল থেকে সিলিকন ভ্যালিতে পৌঁছে ইরফান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।”

অনুপ্রেরণা তরুণদের জন্য

ইরফানের গল্প আজ দেশের হাজারো তরুণের অনুপ্রেরণা। কম সিজিপিএ, গ্রাম থেকে উঠে আসা, চাকরি না পাওয়ার হতাশা — সব বাধা পেরিয়ে যিনি আজ বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রযুক্তি হাব সিলিকন ভ্যালিতে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

ইরফান জানান, তিনি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের তরুণদের জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করতে চান, যাতে তারা বিশ্বমানের কোম্পানিতে কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারে। “প্রচেষ্টা থাকলে সবকিছুই সম্ভব,” — বলেন তিনি।

উপসংহার

গ্রামের ছেলে থেকে সিলিকন ভ্যালির সফর — ইরফানের জীবন যেন এক বাস্তব কল্পকাহিনি। তার গল্প প্রমাণ করে, সুযোগ তৈরি হয় অধ্যবসায় আর আত্মবিশ্বাস থেকে। এখন প্রশ্ন হলো, এমন আরো কতজন ইরফান তৈরি হতে পারে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো থেকে?

এম আর এম – ০০৯৫, Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button