ইরান কয়েক মাসের মধ্যেই সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন শুরু করতে পারে

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-র মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি সম্প্রতি জানিয়েছেন, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পরেও ইরান কয়েক মাসের মধ্যেই সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে পারে। গতকাল, ২৮ জুন, সিবিএস নিউজে এক সাক্ষাৎকারে এই তথ্য প্রকাশ করেন আইএইএ প্রধান।
ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের হামলা ও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ক্ষতি
১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের বিভিন্ন পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়। তেল আবিবের দাবি, এই হামলার লক্ষ্য ছিল ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টায় বাধা দেওয়া। যদিও ইরান বরাবরই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
এর কিছুদিন পর যুক্তরাষ্ট্রও তেহরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়। এই হামলার পর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি জানান, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ক্ষতি “গুরুতর” হলেও বিস্তারিত তথ্য এখনও জানা যায়নি।
পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর অবস্থা ও ইরানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
আইএইএ মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি বলেন, “তবে এখনও কিছু পারমাণবিক স্থাপনা অক্ষত রয়েছে এবং তারা শিগগিরই সেগুলো চালু করতে সক্ষম হবে।” তার মতে, ইরান কয়েক মাসের মধ্যেই, এমনকি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, সেন্ট্রিফিউজ পুনরায় চালু করে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন শুরু করতে পারে।
ইরান বর্তমানে উচ্চমাত্রায় (প্রায় ৬০ শতাংশ) সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন করছে, যা পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য উপযুক্ত মাত্রার নিচে হলেও বেসামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত উচ্চ মানের। তবে এটি আরও বেশি মাত্রায় (৯০ শতাংশ) পরিশোধন করলে তা পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইরানের কাছে থাকা সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের পরিমাণ ও অবস্থান
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, ইরানের কাছে বর্তমানে প্রায় ৪০৮.৬ কেজি (৯০০ পাউন্ড) উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে। এই পরিমাণ ইউরেনিয়াম ৯টির বেশি পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট হতে পারে, যদি তা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধিত হয়।
তবে, হামলার আগে ইরান এই সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের কিছু অংশ বা পুরো অংশ সরিয়ে নিয়েছে কিনা, সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। রাফায়েল গ্রোসি বলেন, “আমরা জানি না এটি এখন কোথায় রয়েছে। কিছু ধ্বংস হয়েছে, আবার কিছু হয়তো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।”
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভবিষ্যৎ: বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদ্বেগ
ইরানের এই দ্রুতগতির পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বিশ্বে ব্যাপক উদ্বেগ ছড়িয়েছে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো ইরানের পারমাণবিক সামর্থ্য বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে। ইরান এবং পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র বিরোধ অনেক বছর ধরেই চলমান একটি নাজুক সমস্যা।
পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিরোধ: আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইনী বাধ্যবাধকতা
ইরান ২০১৫ সালের পরমাণু সমঝোতা (জিসিপিওএ) থেকে একতরফা সরে এসে উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম শুরু করে। তবে এই পদক্ষেপ বিশ্ব সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য আশঙ্কাজনক।
আইএইএ এই পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে এবং ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমের প্রতি বিশেষ নজর রাখছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব সম্প্রদায় ইরানকে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে আহ্বান জানিয়েছে।
সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি বৃদ্ধি ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ
ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক হামলা এবং ইরানের পারমাণবিক ক্ষমতা বৃদ্ধির মধ্যে টানাপোড়েন বিশ্বে একটি বড় নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবে দেখা যাচ্ছে। পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ নিয়ে ইরান ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশ বেড়েই চলছে, যা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ও বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সংকট নিরসনে কূটনৈতিক পথ অনুসরণ করাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা খুবই কঠিন।
বিশ্ব দরবারে ইরানের পারমাণবিক ইস্যু ও ভবিষ্যত
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে। সাম্প্রতিক হামলা ও ক্ষতির পরেও ইরানের দ্রুতগতির সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন শুরু করার সম্ভাবনা বাড়ছে, যা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের কারণ।
বিশ্বকে এখন এই সংকট মোকাবেলায় শান্তিপূর্ণ ও কূটনৈতিক উপায় খুঁজে বের করতে হবে, যাতে পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি থেকে বিশ্বকে মুক্ত রাখা যায়।