ইরানে আবারও বোমা হামলার হুমকি দিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রে ফের একবার ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের ওপর পুনরায় বোমা হামলার হুমকি দিয়েছেন যদি তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে অগ্রগতি সাধন করে। গতকাল শুক্রবার হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে এই কঠোর বক্তব্য দেন ট্রাম্প।
এই ঘটনার পেছনে রয়েছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে চলমান দ্বন্দ্ব এবং মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার অগ্রগতি, যা বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য বড় বিপদের ইঙ্গিত বহন করছে।
পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিক থেকে ইরানের অগ্রগতি নিয়ে উদ্বেগ
ট্রাম্প বলেন, “ইরান যদি পারমাণবিক কার্যক্রমে উন্নতি ঘটায় এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে সক্ষম হয়, তাহলে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় হামলা চালাবে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।”
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্য কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা দ্বারা সম্প্রচারিত হয় এবং তা বিশ্বমঞ্চে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পটভূমি
২০২৫ সালের জুন মাসে মধ্যপ্রাচ্যে তীব্র উত্তেজনার এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। এর আগেই ২১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ বোমারু বিমান ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানে হামলা চালায়। এর আগে ১৩ জুন ইসরাইলও ইরানের বিভিন্ন পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানে।
এই হামলাগুলো পরস্পরের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, যা পরিণত হয় ১২ দিনের দীর্ঘ সংঘাতে। সংঘর্ষে উভয়পক্ষই ব্যাপক ক্ষতি ও ধ্বংসের মুখে পড়ে।
ট্রাম্পের কঠোর অবস্থান এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সম্ভাবনা
সম্প্রতি ন্যাটো সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্প বলেছেন, “ইরান যদি আবার পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেবে।”
তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেন, “ইরান কখনই পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারবে না, এবং ইউরেনিয়ামও সমৃদ্ধ করতে দেয়া হবে না।”
তবে, এই কঠোর হুঁশিয়ারির মাঝেও ট্রাম্প সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তার ভাষ্য, “আমি বিশ্বাস করি, শেষ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে একটি সম্পর্ক গড়ে উঠবে।”
এটি ইঙ্গিত দেয় যে, সংকটের মাঝেও কূটনৈতিক সংলাপের সুযোগ রয়েছে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি: ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি
ইরান দীর্ঘদিন ধরেই পারমাণবিক শক্তি অর্জনের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। দেশটি সঠিক শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করছে বলে দাবি করলেও, পশ্চিমা দেশগুলি সন্দেহ করে যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত।
২০১৫ সালে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি (JCPOA) হয়, যার মাধ্যমে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা সীমাবদ্ধ করে এবং পারমাণবিক স্থাপনাগুলো আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে রাখে।
তবে, ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন JCPOA থেকে একতরফা বেরিয়ে আসে এবং ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এরপর থেকে ইরান ধীরে ধীরে পারমাণবিক কর্মসূচি বৃদ্ধি করছে, যা উত্তেজনার সৃষ্টি করছে।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ও ইসরায়েলের ভূমিকা
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব কমানোর জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইসরায়েল বারবার ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়েছে এবং গোপনযুদ্ধ পরিচালনা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ বোমারু বিমান হামলা পূর্বে নজিরবিহীন এবং এর ফলে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি খুবই অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইরানের পারমাণবিক ক্ষমতা অর্জনের সম্ভাবনা হলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধে ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই হুমকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্বিগ্ন করেছে। অনেক দেশ শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক সমাধান চান এবং যুদ্ধের পরিবর্তে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতী।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ইরানের সঙ্গে আলোচনা ও পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে পুনরায় উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্বের বড় শক্তিগুলো, বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া, ইরান বিরোধী সামরিক পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে এবং পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করার পরামর্শ দিচ্ছে।
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনার সম্ভাব্য প্রভাব
- মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত: সামরিক সংঘাত বেড়ে গেলে পুরো অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
- তেল বাজারে ধাক্কা: মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেলের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হলে বিশ্বব্যাপী তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে।
- আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ঝুঁকি: পারমাণবিক যুদ্ধ বা বিস্তার এড়াতে আন্তর্জাতিক চাপে বৃদ্ধি পাবে।
- শরণার্থী সংকট: সংঘাত বেড়ে গেলে বিপুল সংখ্যক মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইরানকে দেওয়া কঠোর বার্তা এবং বোমা হামলার হুমকি মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে এক ধাক্কায় সংকটময় করে তুলেছে।
যদিও ট্রাম্প কূটনৈতিক সম্পর্কের সম্ভাবনার কথাও বলেছেন, তবুও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি নিয়ে ইরান যদি অগ্রগতি করে, তাহলে তা নতুন বৈশ্বিক সংঘাতের আগুন জ্বালাতে পারে।
বিশ্ববাসীর আকাঙ্ক্ষা একটাই—মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়া। এই সংকটের উত্তরণ কেবল কূটনৈতিক সংলাপ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমেই সম্ভব।