আঞ্চলিক

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণে জড়িতদের ছাত্রত্ব বাতিলের দাবিতে মশাল মিছিল

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাবেক) সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক ছাত্রীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের ঘটনা সমাজকে বিচলিত করেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে এবং ধর্ষণকারীদের কঠোর শাস্তি ও তাদের ছাত্রত্ব বাতিলের দাবি জানিয়ে গত সোমবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একটি বিশাল মশাল মিছিলের আয়োজন করে।

ধর্ষণের অভিযোগ ও ঘটনা

গত ২ মে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দুই তৃতীয় বর্ষের ছাত্র স্বাগত দাস (পার্থ) ও শান্ত তারার (আদনান) বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে মেসে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পর, ১৯ জুন ভুক্তভোগী ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ ওই দুই ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে তাদের বিরুদ্ধে চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।

শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর: ‘ধর্ষকের শাস্তি চাই, ছাত্রত্ব বাতিল চাই’

এই নৃশংস ঘটনার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। গত সোমবার রাত ৯টা থেকে গোলচত্বর থেকে শুরু হওয়া মশাল মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অংশ প্রদক্ষিণ করে প্রধান ফটকে শেষ হয়। সেখানে রাত ১০টার দিকে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

মশাল মিছিলে শিক্ষার্থীরা নানা স্লোগান দেন, যেমন —

  • “ধর্ষকদের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন চাই”
  • “ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে”
  • “আমার সোনার বাংলায় ধর্ষকদের ঠাঁই নাই”
  • “হ্যাঙ দ্য রেপিস্ট, উই ওয়ান্ট জাস্টিস”
  • “সাস্টিয়ান সাস্টিয়ান, এক হও লড়াই কর”

এই স্লোগানগুলো তাদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদের স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ।

শিক্ষার্থীদের বক্তব্য

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র নূরউদ্দিন বলেন, “আমাদের বোনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং ধর্ষকদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। এমন কঠোর শাস্তি দিতে হবে, যাতে অন্য কেউ আর এই ধরনের অপরাধ করার সাহস না পায়।”

অন্য একজন শিক্ষার্থী জেমিমা জামান যোগ করেন, “আমরা চাই অভিযুক্ত ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হোক। মামলা থেমে না গিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আমরা মশাল মিছিলের মাধ্যমে এই বার্তাটি দিচ্ছি।”

প্রশাসনের পদক্ষেপ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিক্রিয়া

ঘটনার পর আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জরুরি সিন্ডিকেট সভার আয়োজন করেছে। এই বৈঠকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সূত্র প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরনের অপরাধকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

ধর্ষণ, নিরাপত্তা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের ও প্রশাসনের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু এখনও দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে নানা ধরনের সমস্যা বিদ্যমান। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা সমাজের একটি দুঃখজনক বাস্তবতা। শিক্ষার্থীদের এ ধরনের হামলা এবং ধর্ষণের ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেজন্য কঠোর আইন ও নিয়মকানুন অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে।

ধর্ষণ রোধে কৌশল ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা

  • সতর্কতা ও সচেতনতা বৃদ্ধি: বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।
  • নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ ও ক্যাম্পাসে নজরদারি: ক্যাম্পাসের প্রবেশপথ, আবাসিক হল এবং একাডেমিক ভবনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা কর্মী ও সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে।
  • ধর্ষণের শাস্তি কঠোর করা: আইন অনুযায়ী ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।
  • মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা: ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক সহায়তা ও কাউন্সেলিং পরিষেবা প্রদান করতে হবে।

বাংলাদেশে ধর্ষণের পরিস্থিতি: একটি চিত্র

বাংলাদেশে ধর্ষণের সংখ্যা প্রতি বছর উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক অবহেলা, বিচার ব্যবস্থার দেরি ও অপরাধীদের প্রতি নরম মনোভাব এই সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন, আইন সংশোধন এবং সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে কিছুটা উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য পরিচিত। কিন্তু সাম্প্রতিক এই ধর্ষণ কাণ্ড শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও প্রতিষ্ঠানটির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ উত্থিত হয়েছে। এই মশাল মিছিল ও প্রতিবাদ আন্দোলন প্রতিষ্ঠানটির দুর্নীতি ও নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের এক শক্তিশালী কণ্ঠস্বর।

শিক্ষার্থীদের ঐক্যই হবে পরিবর্তনের চাবিকাঠি

ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই পারে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে। মশাল মিছিলের মতো শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি শুধু প্রতিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং প্রশাসন ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং বিচার ব্যবস্থা দ্রুতগতিতে কাজ করে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণ কাণ্ড দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এক নতুন সতর্কবার্তা দিয়েছে। এটি আমাদের সকলের দায়িত্ব, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের, যেন ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা হয়। শিক্ষার্থীদের উদ্যোগ ও প্রতিবাদই হবে এ ধরনের নৃশংসতা বন্ধের একমাত্র পথ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button