যশোর বোর্ডে এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের ভুয়া বিজ্ঞপ্তি, বিভ্রান্ত না হওয়ার পরামর্শ

যশোর শিক্ষা বোর্ডে চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভুয়া বিজ্ঞপ্তি পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়েছে, ২৬ জুন অনুষ্ঠিতব্য বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষা প্রশ্নফাঁস ও অনিয়মের কারণে স্থগিত করা হয়েছে। তবে যশোর শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ এই বিজ্ঞপ্তিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বলে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সংশ্লিষ্টদের বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে।
ভুয়া বিজ্ঞপ্তির সূত্র ও ছড়িয়ে পড়া
শনিবার (২১ জুন) রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষত ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একটি ভুয়া বিজ্ঞপ্তি ছড়িয়ে পড়ে। এতে বলা হয়, বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং সেজন্য ২৬ জুনের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিটিতে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. মো. আব্দুল মতিনের নাম ও জাল স্বাক্ষর ব্যবহার করে এটি আরও বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টা করা হয়।
ভুয়া বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়—
“২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষার বাংলা প্রথম পত্র বিষয়ে প্রশ্নপত্রের অনিয়ম ও চুরির প্রমাণ পাওয়ায়, পরীক্ষার্থীদের স্বার্থ ও পরীক্ষার নিরপেক্ষতা রক্ষার্থে ২৬ জুন তারিখের বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হলো। পরীক্ষার পরবর্তী তারিখ পরে জানানো হবে।”
বিজ্ঞপ্তিটি দ্রুত সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অনেক শিক্ষার্থী তাদের কলেজ বা বোর্ডে যোগাযোগ করতে শুরু করে এবং এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।
বোর্ড কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা ও আইনি উদ্যোগ
রোববার (২২ জুন) দুপুরে বিষয়টি যশোর বোর্ড কর্তৃপক্ষের নজরে এলে তৎক্ষণাৎ একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. মো. আব্দুল মতিন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ভুয়া বিজ্ঞপ্তিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন এবং এটি প্রকাশের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ফৌজদারি অপরাধ করেছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,
“বোর্ডের সকল কর্মকর্তা, পরীক্ষার্থী এবং সংশ্লিষ্টদের জানানো যাচ্ছে যে, কে বা কারা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের নাম ও স্বাক্ষর জাল করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভুয়া পরীক্ষা স্থগিতের বিজ্ঞপ্তি ছড়িয়েছে। এটি সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন, বোর্ড কর্তৃপক্ষ এই ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। এইচএসসি ২০২৫ এর পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে।”
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আরও জানান, “এই অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে যশোর কোতোয়ালি মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করছি, সংশ্লিষ্ট দোষীদের দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।”
পুলিশি তদন্ত ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক কাজী বাবুল হোসেন জানান, বোর্ড কর্তৃপক্ষের অভিযোগ পাওয়ার পরই তদন্ত শুরু হয়েছে। পুলিশের একটি বিশেষ টিম এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখছে।
তিনি বলেন, “ভুয়া বিজ্ঞপ্তি যেহেতু শিক্ষা ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে, সেহেতু দোষীদের খুঁজে বের করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।”
পরীক্ষার প্রস্তুতি ও নিরাপত্তা
যশোর শিক্ষা বোর্ড জানিয়েছে, ২৬ জুন অনুষ্ঠেয় বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষার জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। পরীক্ষাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে কেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে এবং প্রশ্নপত্র বিতরণসহ অন্যান্য কার্যক্রমে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।
বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, খুলনা বিভাগের ৫৭৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট ১ লাখ ১৬ হাজার ৩১৭ জন শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠিত হবে ২৪০টি কেন্দ্রে। এ বছর পরীক্ষার্থী সংখ্যা গত বছরের তুলনায় ৬ হাজার ১৯৪ জন কম। গত বছর অংশ নিয়েছিল ১ লাখ ২২ হাজার ৫১১ জন।
এ বছর নতুনভাবে পরিবর্তন আনা হয়েছে কেন্দ্রীয় ভেন্যু ব্যবস্থাপনায়। গতবার যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজ কলেজে পরীক্ষা দিতে পারতেন, এবার তারা নির্ধারিত কেন্দ্রেই অংশগ্রহণ করবে। এই কারণে কেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে ৬টি হয়েছে।
বিভ্রান্তি রোধে বোর্ডের বার্তা
বোর্ড পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক একাধিকবার সাংবাদিকদের মাধ্যমে এবং বোর্ডের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্পষ্ট করেছেন— এইচএসসি ২০২৫ এর পূর্বঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী পরীক্ষাগুলো যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে। তাই কোনো গুজবে কান না দিয়ে শিক্ষার্থীদের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, “পরীক্ষা নিয়ে ভীতি বা বিভ্রান্তি ছড়ালে শিক্ষার্থীদের মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারে। তাই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ, যাচাই না করে কোনো তথ্য বিশ্বাস করবেন না এবং সর্বদা বোর্ডের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট বা কলেজ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সত্যতা যাচাই করুন।”
শেষ কথা
সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ও গুজবের এই প্রবণতা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য এক বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার করে একটি গুরুতর পরীক্ষাকে ঘিরে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপে ফেলা অত্যন্ত নিন্দনীয়। যশোর শিক্ষা বোর্ডের মতো অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডেরও উচিত এই ধরনের সাইবার অপরাধ ঠেকাতে আগাম সতর্কতা জারি করা এবং প্রযুক্তিনির্ভর মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করা।
অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উচিত— যাচাই-বাছাই করে তথ্য গ্রহণ করা, যাতে কোনো চক্রান্ত বা বিভ্রান্তি শিক্ষার পরিবেশকে প্রভাবিত না করতে পারে।