জাতীয়

দেশে ৮৫ শতাংশ মানুষ সন্ধ্যার পর একা চলাফেরায় নিরাপদ বোধ করেন

Advertisement

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে’ (সিপিএস) জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদনে প্রকাশ হয়েছে, দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ সন্ধ্যার পর নিজ এলাকার আশপাশে একা চলাফেরা করতে নিরাপদ মনে করেন। তবে নারী ও পুরুষের মধ্যে নিরাপত্তার অনুভূতিতে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা গেছে। নারীদের মধ্যে মাত্র ৮০ শতাংশ নিরাপদ বোধ করেন, যেখানে পুরুষের সংখ্যাটা ৮৯ শতাংশের কাছাকাছি।

জরিপের পেছনের বড় চিত্র: নিরাপত্তা, সেবা ও দুর্নীতি

সিপিএস জরিপে গত এক বছরে সরকারি সেবা নিতে গিয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ নাগরিককে ঘুষ দিতে হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ), আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, পাসপোর্ট অফিস ও ভূমি নিবন্ধন অফিসে এই দুর্নীতি বেশি।
জরিপে অংশ নেয়া নাগরিকরা জানায়, বিআরটিএ অফিসে সেবা নিতে গিয়ে ৬৩ শতাংশের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়া হয়, আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় এই হার ৬২ শতাংশ।

জরিপে উঠে এসেছে নিরাপত্তার অবস্থা

  • সন্ধ্যার পর একা চলাফেরা নিরাপদ মনে করেন:
    • মোট: ৮৪.৮১%
    • পুরুষ: ৮৯.৫৩%
    • নারী: ৮০%
  • নিজ বাড়িতে নিরাপদ বোধ করেন:
    • মোট: ৯২.৫৪%
    • পুরুষ: ৯৩%
    • নারী: ৯২%

সরকারি সেবা গ্রহণে দুর্নীতি ও ঘুষের অবস্থা

সরকারি সেবা নিতে গিয়ে প্রায় প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনকে ঘুষ দিতে হচ্ছে। গ্রামে ৩২% এবং শহরে ৩০% নাগরিক ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। নারীরা পুরুষের তুলনায় কম ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

বিভিন্ন সরকারি অফিসে ঘুষের হার:

  • বিআরটিএ অফিস: ৬৩%
  • আইন প্রয়োগকারী সংস্থা: ৬২%
  • পাসপোর্ট অফিস: ৫৭%
  • ভূমি নিবন্ধন: ৫৫%
  • আদালত: ৫৪%
  • ভূমি রেকর্ড/সেটেলমেন্ট কার্যালয়: ৫১%
  • কাস্টমস ও ভ্যাট অফিস: ৩৫%
  • ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়: ৩৩%
  • জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়: ২৬%
  • কর কার্যালয়: ১৪%
  • কৃষি কার্যালয়: ৯%
  • শিক্ষা কার্যালয়: ৩%

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ও অভিজ্ঞদের মন্তব্য

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানান, ঘুষের হার কিছুটা কম মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ঘুষ দেওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। তিনি বলেন, “আমার ধারণা ছিল, সরকারি সেবা নিতে সবাইকেই ঘুষ দিতে হয়।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, যেসব দপ্তরে কম ঘুষ দেয়া হয় বলে মনে হয়, সেখানেও দুর্নীতি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ঘুষের পরিবর্তে বদলি-বাণিজ্যের সমস্যা বেশি।

তিনি আরও বলেন, “নিজের বাড়িতে নিরাপদ বোধ করার হার শতভাগ হওয়া উচিত। তবে বর্তমানে ৯৩% নাগরিকই এই নিরাপত্তা বোধ করতে পারছে না, যা উদ্বেগজনক।”

সরকারি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেবায় সন্তুষ্টি কম

  • গত এক বছরে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন ৪৭% নাগরিক।
  • স্বাস্থ্যসেবা সহজে পাওয়া গেছে ৮৩%, কম খরচে পাওয়া গেছে ৮৯% হলেও সন্তুষ্টি যথেষ্ট নয়।
  • স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মান, সেবাগ্রহীতার সঙ্গে আচরণ ও চিকিৎসকের সময় দেওয়ার বিষয়ে সন্তুষ্টি যথাক্রমে ৬৫%, ৬৩% ও ৬৩%।

শিক্ষা ক্ষেত্রে, ৪১% নাগরিকের কমপক্ষে একজন সন্তান সরকারি প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে।

  • সহজে যাতায়াতের সুযোগ পায় ৯৬%
  • শিক্ষা ব্যয় সামর্থ্যের মধ্যে পায় ৯৩%
  • শিক্ষার মানে সন্তুষ্টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬৮%, মাধ্যমিকে ৭২%

অন্যান্য সরকারি সেবা ও বৈষম্য

অন্য সরকারি সেবার ক্ষেত্রে (যেমন পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, জন্ম নিবন্ধন ইত্যাদি) ৭৮% নাগরিক সহজে সেবা পায়, আর ৭৬% সেবার খরচ সামর্থ্যের মধ্যে বলে। তবে সেবাদান প্রক্রিয়া, সময়মতো সেবা এবং সমান আচরণে সন্তুষ্টি যথাক্রমে ৬৩%, ৫৬% ও ৫১%।

গত বছর দেশের ১৯% মানুষ কোনো না কোনো বৈষম্য বা হয়রানির শিকার হয়েছেন, যেখানে নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি ভুক্তভোগী। মাত্র ৫% শিকাররা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেছেন।

রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও মতামত প্রকাশে অমনোযোগ

শুধুমাত্র ২৭% নাগরিক মনে করেন তারা সরকারের কাজ সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করতে পারেন। আর মাত্র ২২% মনে করেন তারা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “গত ১৫ বছরে ভোট হয়নি, তাই জনগণ মতামত দিতে পারে না। স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হলে জনগণ ক্ষমতায়ন অনুভব করবে।”

বিবিএসের এই জরিপ থেকে স্পষ্ট হয়, দেশের মানুষ নিরাপত্তা বোধ করলেও নারীরা তুলনায় কম নিরাপদ মনে করেন। সরকারি সেবা গ্রহণে দুর্নীতি এখনও ব্যাপক, বিশেষ করে বিআরটিএ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও পাসপোর্ট অফিসে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেবায় সন্তুষ্টি কম, এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণে জনগণের মনোবল এখনও দুর্বল। সরকারি সেবা প্রদান প্রক্রিয়া উন্নয়নে ও দুর্নীতি নির্মূলে আরও কঠোর পদক্ষেপ জরুরি।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button