ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করছি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এখনই নয়: অর্থ উপদেষ্টা

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত বৈশ্বিকভাবে জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে—এমন পূর্বাভাসের মধ্যেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এখনই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না। বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রয়েছে সরকার। মঙ্গলবার (১৭ জুন) সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়–সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এই মন্তব্য করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এটা যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে অবশ্যই আমাদের ওপর কিছুটা প্রভাব পড়বে। তবে এখনই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না। আমরা সব দিক পর্যবেক্ষণ করছি।’
এলএনজি আমদানি আগের দরেই
অর্থ উপদেষ্টা জানান, সরকার বর্তমানে যে জ্বালানি সরবরাহ চুক্তিগুলোর আওতায় কাজ করছে, সেগুলোর ওপর যুদ্ধের তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব পড়েনি। বিশেষ করে আজকের বৈঠকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির একটি প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যার দর আগের চুক্তির মতোই। ‘ভাগ্য ভালো যে আগের দরেই আমরা এটি পাচ্ছি,’ বলেন উপদেষ্টা।
উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি টোটাল এনার্জিস গ্যাস অ্যান্ড পাওয়ার থেকে এক কার্গো এলএনজি আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে ক্রয় কমিটি। এক কার্গোতে থাকবে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার মিলিয়ন মেট্রিক ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) গ্যাস। এর জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬২১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। প্রতি এমএমবিটিইউর দাম পড়ছে ১৫ দশমিক ১৭ মার্কিন ডলার।
যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিকল্প চিন্তা আছে
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয়, সেক্ষেত্রে সরকারের কোনো বিকল্প পরিকল্পনা আছে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আছে। এ নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। কারণ যুদ্ধের প্রভাবে কেবল জ্বালানি তেল নয়, সার এবং জাহাজ চলাচলও বিঘ্নিত হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশেষ করে হরমুজ প্রণালির মাধ্যমে বিশ্ববাজারে তেল সরবরাহ হয়। সেখানে যদি উত্তেজনা বেড়ে যায়, তাহলে জাহাজ চলাচলে জটিলতা তৈরি হবে, যার প্রভাব আমাদের আমদানির ওপরও পড়বে। তবে আমরা মনে করি যুদ্ধটি দীর্ঘস্থায়ী হবে না।’
বাজেট ও ক্রয় প্রস্তাবের পর্যালোচনা
মঙ্গলবারের বৈঠকে মোট পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। যার মধ্যে অন্যতম ছিল সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামোর পুনঃনির্মাণ প্রকল্প। যদিও এ প্রকল্পের পূর্ত কাজের প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছে। প্রকল্পটি ছিল—‘২০২২ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ সড়ক বিভাগাধীন বিভিন্ন সড়ক, সেতু ও কালভার্টসমূহের জরুরি পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণ’।
অন্যদিকে, কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো) বাংলাদেশ থেকে ৩০ হাজার টন ইউরিয়া সার কেনার প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে বৈঠকে। এতে ব্যয় হবে ১৪০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। প্রতি টনের দাম পড়ছে ৩৮৩ দশমিক ২৫ মার্কিন ডলার। সার আমদানিতে মোট ব্যয় হবে ১ কোটি ১৪ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার।
বিসিক কেমিক্যাল পার্ক প্রকল্পেও অগ্রগতি
‘বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, মুন্সিগঞ্জ (দ্বিতীয় সংশোধিত)’ প্রকল্পের আওতায় ড্রেন, গেট, গার্ড শেড ও অন্যান্য নির্মাণসংক্রান্ত পূর্ত কাজের ক্রয় প্রস্তাবও অনুমোদিত হয়েছে বৈঠকে। ১১১ কোটি ৫৮ লাখ টাকার এ কাজটি পেয়েছে বিডিই লিমিটেড ও কোহিনুর এন্টারপ্রাইজের যৌথ উদ্যোগ।
বৈশ্বিক অস্থিরতা ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা
বিশ্বজুড়ে চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার অনেক বেশি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে যেন দেশের জনগণ জ্বালানি বা সার সংকটে না পড়ে। আমরা চাচ্ছি না এমন অবস্থার সৃষ্টি হোক, যেখানে হঠাৎ দাম বেড়ে জনগণ ভোগান্তিতে পড়বে।’
তিনি জানান, আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর বাংলাদেশ যে হারে নির্ভরশীল, তাতে সংকট হলে কিছুটা চাপ পড়বেই। কিন্তু তা মোকাবিলায় যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া তিনি বলেন, ‘আমাদের আমদানি কাঠামো অনেকটাই পূর্বনির্ধারিত। আন্তর্জাতিক বাজারে হঠাৎ দাম বাড়লেও তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে না। বরং দীর্ঘ মেয়াদে পরিস্থিতির যদি অবনতি ঘটে, তখনই সরকারের পক্ষ থেকে মূল্যসামঞ্জস্যের বিষয়ে চিন্তা করা হবে।’
যুদ্ধ পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি সরবরাহ রুট হরমুজ প্রণালির ওপর ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে সরকার পর্যবেক্ষণ করছে। অর্থ উপদেষ্টা মনে করেন, ‘বিকল্প সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়েও আমাদের চিন্তা রয়েছে। যদি প্রয়োজন হয়, অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি বা অভ্যন্তরীণ জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে।’
এ সময় অর্থ উপদেষ্টা জানান, ‘বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। এতে কোনো তাড়াহুড়ো করা হবে না। প্রতিটি সিদ্ধান্ত বাস্তব পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়েই নেওয়া হবে।’