বিশ্ব

তেহরানে ধবধবে খেলনা রাজহাঁস ও শিশুর হাতে রক্তের দাগ

একটি ছবির মাঝে কত গল্প লুকিয়ে থাকতে পারে?
কখনো হয়তো হাজার শব্দও সেই গল্পকে বর্ণনা করতে পারে না।
১৫ জুন তেহরানের কেন্দ্রস্থল কেশাভার্জ বুলেভার্ডে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ঠিক এমনই একটি ছবি প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা এএফপি—যেখানে ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে এক শিশু, কোলে তার ধবধবে সাদা খেলনা রাজহাঁস, আর অপর হাতে রক্তের দাগ।

শিশুর মন আর তার ‘নিয়তি’

একটি শিশু জানে না যুদ্ধ কী, জানে না কূটনীতি, রাজনীতি, কিংবা ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন। সে কেবল জানে তার খেলনার কথা।
পুতুল, রাজহাঁস, রং, কাগজের নৌকা—এসব নিয়েই তার জগৎ।
কিন্তু এই শিশুটি এখন যুদ্ধ চেনে। চেনে ক্ষেপণাস্ত্রের শব্দ। চেনে ভয়ের মুখ।
সে জানে, যখন আকাশের গর্জন শোনা যায়, তখন খেলনা বাঁচাতে হয়—কারণ মানুষ বড় হয়ে উঠলেই সব হারানোর ভয়ে ছোটদের জীবন বদলে দেয়।

ছবিতে দেখা যায়, আহত এক ইরানি নারীর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট এক শিশু। ডান হাতে বুকে আঁকড়ে ধরে আছে একটি রাজহাঁস—খেলনা, সাদা, ধবধবে।
কিন্তু তার অন্য হাতটি রক্তে রঞ্জিত। হয়তো তার মা, হয়তো পরিচিত কেউ, হয়তো অপরিচিত আহত কেউ—যার রক্তে রঞ্জিত হয়েছে শিশুটির কোমল হাত।

আশ্রয় নয়, সঙ্গীর খোঁজ

এই শিশু নিজের আশ্রয়ের খোঁজে নয়, বরং তার প্রিয় খেলনাটিকে নিয়ে অনিশ্চিত পথে নেমে পড়েছে।
তেহরানের ধ্বংসস্তূপের নিচে সে হয়তো খুঁজেছে প্রতিটি খেলনাকে।
আর যে রাজহাঁসটিকে পেয়েছে, তাকেই সঙ্গী করে তুলেছে যুদ্ধের পথে।

এ যেন কল্পনার সেই রাজপুত্র বা রাজকন্যার গল্প নয়, এক নির্মম বাস্তবতার নিঃসঙ্গ সফর।

খেলনার জন্য শুশ্রূষা

শিশুটি জানে না চিকিৎসা কী। তবুও সে তার খেলনাটিকে রক্ষা করছে যেন পরম মমতায়।
যেন মনে মনে বলছে:

“তুমি ভয় পেও না, আমি আছি।”

এই ভালোবাসা, এই টান, এই হৃদয়ের কোমলতা যেন আরও একবার প্রমাণ করে—শিশুদের হৃদয় সবচেয়ে মানবিক, সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে বিশুদ্ধ।

আর বড়রা?

অন্যদিকে বড়রা কী করছে?
একটা দেশ আরেকটা দেশের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছে।
একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আর হাজারো বাড়ি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
একটা বোতাম চাপলেই এক জীবন মুছে যাচ্ছে।
তারা ভুলে যায়, প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্রের শব্দ একটি শিশুর কান্না ডেকে আনে।
প্রতিটি ধ্বংসের ভেতর থেকে উঠে আসে ছোট্ট হাতে ধরা খেলনার আর্তি।

একটি প্রশ্ন

এই ছবিটি যেন আমাদের সামনে তুলে ধরে এক নীরব কিন্তু তীব্র প্রশ্ন—
“এই শিশুটির অপরাধ কী?”

তার রাজহাঁস কেন যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে থাকবে?
তার জন্য পৃথিবীতে একটু শান্তি রাখা যাবে না?
তার চোখে যেন শুধু খেলা, রং, ভালোবাসা আর গল্প থাকে—ক্ষেপণাস্ত্র নয়।

যুদ্ধ কেবল সেনাদের মাঠে হয় না।
এটি এক একটি শিশুর ঘুম কেড়ে নেয়, হাসি মুছে দেয়, খেলনার রাজহাঁস রক্তে রঞ্জিত করে।
আমরা যখন বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করি, তখন যদি একটি শিশুর মায়া, তার রাজহাঁসের প্রতি ভালোবাসা, আমাদের হৃদয়ে নাড়া না দেয়—তবে হয়তো আমাদের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকাটাই প্রশ্নের মুখে পড়ে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button