মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যাত্রা করছে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী

মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে একটি নতুন মোড় নিয়েছে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘাত যখন ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, তখন এই অঞ্চলের দিকে রওনা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস নিমিৎজ (USS Nimitz)। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যাত্রা
বিশ্বখ্যাত বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সোমবার (১৬ জুন) সকালে ইউএসএস নিমিৎজ দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। সাধারণত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী নিয়মিত মোতায়েন থাকলেও এই মুহূর্তে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ রণতরীর হঠাৎ মধ্যপ্রাচ্যে যাত্রা যুদ্ধের প্রস্তুতির ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা।
এর আগে ইউএসএস নিমিৎজের চলতি সপ্তাহে ভিয়েতনামের দানাং বন্দরে সফরের কথা ছিল। তবে হঠাৎ করে সে সফর বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। দুটি নির্ভরযোগ্য ভিয়েতনামী সূত্র জানিয়েছে, ১৯ থেকে ২৩ জুন দানাং বন্দরে যে সফরটি হওয়ার কথা ছিল, তার আওতায় ২০ জুন নির্ধারিত অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানও বাতিল করা হয়েছে।
জরুরি অপারেশনাল প্রয়োজনীয়তা
রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, হ্যানয়ের মার্কিন দূতাবাসের একটি অভ্যন্তরীণ চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘জরুরি অপারেশনাল প্রয়োজনীয়তা’-র কারণে ইউএসএস নিমিৎজকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো হচ্ছে এবং এর ফলেই ভিয়েতনামে পূর্বনির্ধারিত কার্যক্রম বাতিল করা হয়েছে।
তবে এই বিষয়ে মন্তব্যের জন্য রয়টার্সের পক্ষ থেকে মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করা হলেও তারা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এবং আগাম সংকেত
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি নতুন কিছু নয়। তবে দক্ষিণ চীন সাগর থেকে সরাসরি মধ্যপ্রাচ্যে ইউএসএস নিমিৎজের যাত্রা যুক্তরাষ্ট্রের একটি কৌশলগত বার্তা বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এতে করে স্পষ্ট হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে নিজস্ব স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখতে পিছপা হবে না।
মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটেও বলা হয়েছে যে, ইউএসএস নিমিৎজ সম্প্রতি দক্ষিণ চীন সাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা অভিযান পরিচালনা করেছে। এটি ছিল ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের নিয়মিত মিশনের অংশ। তবে এত দ্রুত মধ্যপ্রাচ্যে রণতরী পাঠানোর সিদ্ধান্ত বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে একটি জিওপলিটিকাল টার্নিং পয়েন্ট।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এবং সম্ভাব্য বিস্তার
বর্তমানে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যেভাবে সংঘাত বাড়ছে, তাতে পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক যুদ্ধের সম্ভাবনা অস্বীকার করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি ইসরায়েল তেহরানের আকাশসীমায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দাবি করেছে এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলারও খবর পাওয়া গেছে।
এই অবস্থায় মার্কিন রণতরীর আগমন পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ ইরানকে চাপে ফেলতে পারে এবং একই সঙ্গে ইরান সম্ভাব্য প্রতিশোধ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকের মতামত
ওয়াশিংটন ডিসির স্টিমসন সেন্টারের বিশিষ্ট ফেলো বারবারা স্লাভিন রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
উদ্বেগের বিষয় হলো এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে এবং আরও বিস্তৃত হবে। ইরান এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক স্থাপনাগুলোকে টার্গেট করতে পারে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহী রণতরীসহ অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করছে।”
তিনি আরও বলেন,”আমার মনে হয় না ইরানিরা যুক্তরাষ্ট্রকে এমন একটি সংঘাতে জড়িয়ে ফেলতে চায়, যা তাদের জন্য আরও ধ্বংসাত্মক হতে পারে। তবে, এই মুহূর্তে ইরানকে প্রতিহত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হচ্ছে।”
ভবিষ্যতের আশঙ্কা ও কূটনৈতিক সম্ভাবনা
বিশ্ব রাজনীতিতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, একটি আঞ্চলিক সংঘাত যেন বিশ্বব্যাপী সামরিক দ্বন্দ্বে রূপ না নেয়। বিশেষ করে ইউএসএস নিমিৎজের মতো রণতরী যদি সরাসরি ইরান ঘেঁষা উপসাগরীয় অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়, তবে সেটি তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো, আন্তর্জাতিক শিপিং রুট, এমনকি বিশ্ববাজারেও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে কূটনৈতিক সমাধানের পথ আরও সংকীর্ণ হয়ে পড়ে এবং উত্তেজনার মাত্রা অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে যেতে পারে।
উপসংহার
ইউএসএস নিমিৎজের মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যাত্রা নিঃসন্দেহে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এটি শুধু একটি সামরিক গতিবিধিই নয়, বরং বর্তমান ভূরাজনৈতিক সংকটের একটি শক্ত বার্তাও। বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পরবর্তী পরিণতির দিকে এবং মার্কিন সামরিক কৌশলের গতিপথ যে সেখানে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।