বানিজ্য

ড্রোন ও উড়ুক্কু যান নিয়ে স্বল্প উচ্চতার আকাশ অর্থনীতিতে বিশ্বনেত্রী চীন

শহর-গ্রাম থেকে সীমান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে ড্রোন, গড়ে উঠছে নতুন শিল্প

ঢাকা, ১৬ জুন ২০২৫ – বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো দৃশ্য এখন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে চীনের আকাশ পথে। ড্রোন এবং স্বচালিত উড়ুক্কু যান ব্যবহার করে দেশটি স্বল্প উচ্চতার আকাশ অর্থনীতিকে বিশ্বব্যাপী নতুন একটি অর্থনৈতিক ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া। সরকার ও বেসরকারি খাত একসাথে কাজ করে এই নতুন প্রযুক্তিকে নাগরিক জীবনের অংশ করে তুলছে।

চীনের সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে এই খাত থেকে প্রায় ২০ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা আগামী দশক জুড়ে বহুগুণ বাড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

স্বল্প উচ্চতার আকাশ অর্থনীতি: কি এবং কেন?

স্বল্প উচ্চতার আকাশ অর্থনীতি বলতে ৬০০ মিটারের নিচের আকাশপথে পরিচালিত বাণিজ্যিক ও সেবামূলক কার্যক্রমকে বোঝায়। এখানে ড্রোনের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন, স্বচালিত উড়ন্ত গাড়ি দ্বারা যাত্রী পরিবহন, জরুরি সেবা পৌঁছানো, কৃষি কার্যক্রম ও নজরদারি অন্তর্ভুক্ত।

চীনের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ আশা করছে, ২০২৫ সালের মধ্যে এই খাতের বার্ষিক আয় দাঁড়াবে ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ২০,৮০০ কোটি ডলার), যা ২০৩৫ সালের মধ্যে বেড়ে সাড়ে তিন লাখ কোটি ইউয়ানে পৌঁছাতে পারে।

ড্রোন ও উড়ুক্কু যান: চীনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি

চীনে ইতিমধ্যেই স্বচালিত উড়ন্ত গাড়ি বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহনে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। ডেলিভারি ড্রোনের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রেও ব্যাপক বৃদ্ধি দেখা গেছে।

বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই ড্রোন ডেলিভারি প্রযুক্তি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে থাকলেও, চীনে এটি এখন বাস্তবতার অংশ। মেইতুয়ান নামের জনপ্রিয় খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ২০২৪ সালে প্রায় ২ লাখ ড্রোন দিয়ে পণ্য সরবরাহ করেছে, যা আগের বছরের থেকে প্রায় দ্বিগুণ।

উড়ুক্কু যান তৈরিতে ইহ্যাং কোম্পানির শেয়ারদর গত দুই বছরে প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে, যা এই খাতের দ্রুত উন্নয়নের নিদর্শন।

বিস্তৃত ব্যবহার ও সামাজিক প্রভাব

চীনের শহর ও গ্রাম, সীমান্ত ও দ্বীপপ্রভূত এলাকায় ড্রোনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এক বছরে ড্রোনে পণ্য সরবরাহ হয়েছে ২৭ লাখেরও বেশি বার।

  • শহরের হাসপাতালগুলোতে জরুরি রক্ত সরবরাহে ড্রোন
  • কৃষিক্ষেত্রে সার ও কীটনাশক ছিটানোর লক্ষ লক্ষ কৃষি ড্রোন
  • উচ্চ ভবনে আগুন নিয়ন্ত্রণে ড্রোন
  • সীমান্ত এলাকায় মাদক চোরাচালানের নজরদারি
  • রোগ পরীক্ষার নমুনা দ্রুত ল্যাবে পৌঁছানো

এই বিচিত্র ব্যবহার নতুন অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে।

সরকারের উদ্যোগ ও নীতিমালা

২০২৩ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং ‘লো অল্টিটিউড ইকোনমি’কে জাতীয় প্রবৃদ্ধির প্রধান খাত হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের পাশাপাশি ড্রোন ও উড়ুক্কু যান প্রযুক্তি দ্রুত উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা সংস্থা আলাদা বিভাগ চালু করেছে, যা এই নতুন আকাশ অর্থনীতির নীতি ও প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে।

শেনজেন, হেফেইসহ ছয়টি শহরকে ৬০০ মিটার নিচের আকাশপথ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘লো অল্টিটিউড প্রযুক্তি ও প্রকৌশল’ বিষয়ে নতুন কোর্স চালু করেছে।

বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

চীনের বেসরকারি ড্রোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০২৪ সালের শেষে ২২ লাখ ছাড়িয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশজুড়ে কমপক্ষে ১০০টি কোম্পানি উড়ুক্কু যান উৎপাদন করবে বলে আশা প্রকাশ করা হচ্ছে।

বিশেষ করে, অর্থনৈতিক মন্দায় পড়া অনেক জেলা প্রশাসন নতুন এই শিল্প নিয়ে আগ্রহী, যা তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ দিশা

দীর্ঘদিন চীনের আকাশপথ ছিল মূলত সামরিক নিয়ন্ত্রণাধীন। প্রায় ৯০ শতাংশ আকাশপথ সামরিক কাজে ব্যবহৃত হতো, যার কারণে বেসামরিক বাণিজ্য সীমিত ছিল।

কিন্তু বর্তমানে এই নিয়ন্ত্রণের অবকাঠামো বদলাতে শুরু করেছে। স্বল্প উচ্চতার আকাশ অর্থনীতির জন্য আকাশপথ খোলা হচ্ছে বাণিজ্যিক কাজে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও কোম্পানিগুলো নতুন নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা তৈরি করছে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বব্যাপী ড্রোন ও উড়ুক্কু যান প্রযুক্তির উন্নয়ন চললেও, চীনের এই খাত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালমার্ট ২০২১ সাল থেকে ১.৫ লাখবার ড্রোন ব্যবহার করে পণ্য ডেলিভারি করছে।

তবে চীনে এটি শুধু পরীক্ষামূলক নয়, বাস্তব আকার ধারণ করেছে এবং বাণিজ্যিক পর্যায়ে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

চীন প্রযুক্তি ও নীতিমালা সংযোগ করে স্বল্প উচ্চতার আকাশ অর্থনীতি গড়ে তুলছে যা ভবিষ্যতে দেশটির অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলবে। ড্রোন ও উড়ুক্কু যান শুধুমাত্র বাণিজ্যিক নয়, সামাজিক সেবার ক্ষেত্রেও বিপ্লব ঘটাচ্ছে।

২০২৫ সালের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার কোটি ডলারের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে যাচ্ছি এমন এই খাত, ২০৩৫ সালের মধ্যে আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে আশাবাদী বিশ্লেষকরা।

নতুন প্রযুক্তির প্রসারে চীনের এই পদক্ষেপ বিশ্বের অন্য দেশগুলোর জন্য দিকনির্দেশক হতে পারে। ড্রোন ও উড়ুক্কু যান চালু করে স্বল্প উচ্চতার আকাশ অর্থনীতির যাত্রা চীনের একটি নতুন অর্থনৈতিক যুগের সূচনা করছে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button