
আন্তর্জাতিক ফুটবলের ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হলো সুইডেনের একটি নিম্ন বিভাগীয় ক্লাবের দাবির মাধ্যমে। সুইডেনের তৃতীয় স্তরের ফুটবল ক্লাব টর্নস আইএফ-এর খেলোয়াড়দের দীর্ঘদিনের আপত্তি ও প্রস্তাবের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বোর্ড (আইএফএবি) অবশেষে অফসাইড নিয়মে ঐতিহাসিক পরিবর্তন এনেছে। নিয়মটির নতুন ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ এখন থেকে বিশ্বজুড়ে ফুটবল খেলায় কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
পরিবর্তনের পেছনের গল্প: টর্নস আইএফ-এর দৃঢ় অবস্থান
গত দুই বছর ধরে টর্নস আইএফ নিয়মের একটি অসঙ্গতি নিয়ে সোচ্চার ছিল। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, বল প্রথমবার স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে অফসাইড নির্ধারণ করা হতো। কিন্তু খেলোয়াড়রা বহুক্ষেত্রে বল থামিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পরে পাস করতেন, অথচ অফসাইড সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো আগের মুহূর্ত অনুযায়ী। ফলে প্রতিপক্ষ দলের জন্য তৈরি হতো বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি এবং অনেক সময় এটি অনৈতিক সুবিধা এনে দিত আক্রমণকারী দলের পক্ষে।
টর্নস আইএফ-এর খেলোয়াড় টিম নিলসেন বলেন, “আমরা বারবার দেখেছি, একদল খেলোয়াড় অফসাইড পজিশনে থাকা সত্ত্বেও বল থামিয়ে অপেক্ষা করে এমন সময় পাস দিচ্ছে, যখন সহ-খেলোয়াড় ওপেন অবস্থানে চলে আসে। এতে নিয়মের স্বচ্ছতা হারিয়ে যাচ্ছিল।”
নতুন সংশোধিত নিয়ম কী বলছে?
আইএফএবি-এর নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এখন থেকে বল প্রথম স্পর্শ নয়, বরং বল পাস করার প্রকৃত মুহূর্তেই অফসাইড চেক করা হবে। অর্থাৎ যদি কোনো খেলোয়াড় বল থামিয়ে কিছুক্ষণ পর পাস করেন, তবে অফসাইড দেখা হবে সেই মুহূর্তে, যখন পাসটি প্রদান করা হচ্ছে। এই নিয়ম ফুটবলে কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে বড় পরিবর্তন আনবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আইএফএবি-এর টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ডেভিড এলেরি জানান, “টর্নস আইএফ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, নিয়মে স্বচ্ছতা ও নির্ভুলতা কতটা জরুরি। তাদের অধ্যবসায় এবং যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণ আমাদের এই পরিবর্তন আনতে অনুপ্রাণিত করেছে।”
নিয়ম পরিবর্তনের প্রভাব
বিশ্বব্যাপী ফুটবলের আইন পরিবর্তনে সাধারণত বড় ক্লাব কিংবা উচ্চ স্তরের টুর্নামেন্টগুলোর প্রভাব বেশি দেখা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়েছে। সুইডেনের তৃতীয় স্তরের ক্লাব হওয়া সত্ত্বেও টর্নস আইএফ তাদের তত্ত্ব ও যুক্তি যথেষ্ট জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছে, যা শেষপর্যন্ত আইএফএবি-কে নিয়ম সংশোধনে বাধ্য করেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই পরিবর্তন ফুটবল খেলায় ন্যায্যতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। এছাড়া VAR (Video Assistant Referee) প্রযুক্তির মাধ্যমে অফসাইড নির্ধারণ আরও নিখুঁত হবে এবং কোনও ফাঁকফোকর দিয়ে দলগুলো আর সুবিধা নিতে পারবে না।
খেলোয়াড় ও কোচদের প্রতিক্রিয়া
টর্নস আইএফ-এর কোচ মার্টিন ওলসেন বলেন, “আমরা গর্বিত যে আমাদের ছোট ক্লাব এমন একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা করতে পেরেছে। এটি দেখায়, খেলোয়াড়দের কণ্ঠস্বর কতটা গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তন কখনোই ছোট থেকে আসতে বাধা পায় না।”
এদিকে অনেক ইউরোপিয়ান ক্লাবের খেলোয়াড়রাও এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছেন। জার্মানির বুন্দেসলিগা-র একজন মিডফিল্ডার বলেন, “ফুটবলের সবচেয়ে জটিল নিয়মগুলোর মধ্যে একটি ছিল অফসাইড। নতুন ব্যাখ্যা নিয়মটিকে আরও সহজ ও কার্যকর করবে।”
ভবিষ্যতের দৃষ্টিকোণ
বিশ্ব ফুটবলে অফসাইড নিয়ে বহুবার বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৮ বিশ্বকাপের সময়েও বেশ কিছু সিদ্ধান্ত আলোচনার জন্ম দিয়েছিল, যেখানে বল পাসের সময় ও খেলোয়াড়ের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এই নতুন নিয়ম সেই ধোঁয়াশা অনেকটা দূর করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে এই পরিবর্তনের প্রয়োগে কিছু চ্যালেঞ্জও থাকবে। বিশেষ করে VAR রিভিউয়ের সময় আরও নির্ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য রেফারিদের নতুন প্রশিক্ষণ এবং ম্যাচ অফিসিয়ালদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের পরিসর বাড়ানো দরকার।
সমাপ্তি
ফুটবলের ইতিহাসে নিয়ম পরিবর্তন খুবই স্পর্শকাতর এবং সময়সাপেক্ষ একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু একটি ছোট ক্লাবের দৃঢ়তা ও যুক্তিসম্পন্ন দাবির ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী একটি নিয়মের ব্যাখ্যায় পরিবর্তন আনায় আবারও প্রমাণ হলো — খেলার আত্মা কেবল মাঠের ১১ জন খেলোয়াড়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদের চিন্তা, পর্যবেক্ষণ ও নৈতিক অবস্থানেও নিহিত।
এই পরিবর্তন ফুটবলকে আরও স্বচ্ছ, ন্যায্য এবং কৌশলগতভাবে পরিপূর্ণ করে তুলবে, এমনটাই প্রত্যাশা বিশ্ব ফুটবলপ্রেমীদের।