
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ যেভাবে ইরানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য থেকেও কমান্ডারদের অবস্থান নির্ধারণ করে হত্যা করেছে—সেই কৌশল ও প্রযুক্তিগত পদ্ধতির রোমহর্ষক বিবরণ উঠে এসেছে সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারে।
মোসাদের অভ্যন্তরীণ কৌশল
ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (IRGC) একের পর এক শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তার মৃত্যু যেন ছিল নিখুঁত পরিকল্পনার অংশ। সম্প্রতি ইসরায়েলের সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা রামি ইগ্রা বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন, মোসাদ দীর্ঘদিন ধরে এসব কমান্ডারের গতিবিধি ট্র্যাক করে টার্গেট কিলিং পরিকল্পনা করেছে।
তিনি বলেন, “সবকিছু প্রযুক্তির মাধ্যমে করা হয়েছে। যদি আপনার কাছে মোবাইল থাকে, তাহলে আপনি কোথায় থাকেন, কার সঙ্গে যোগাযোগ করেন—সব তথ্যই ট্র্যাক করা সম্ভব।”
প্রযুক্তির ব্যবহার: মোবাইল ট্র্যাকিং ও সাইবার নজরদারি
মোসাদের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং ও সাইবার জগৎ থেকে তথ্য সংগ্রহ। ইসরায়েলি এই গোয়েন্দা সংস্থা শুধু ফোন কল নয়, বরং স্মার্টফোনে ব্যবহৃত অ্যাপ, জিপিএস লোকেশন এবং এমনকি ঘুমের সময়কার গতিবিধিও বিশ্লেষণ করেছে।
রামি জানান, টার্গেটদের বাসা, ঘুমানোর ঘর এবং এমনকি বেডরুম পর্যন্ত নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এরপর এসব লক্ষ্যবস্তুতে চালানো হয় গাইডেড মিসাইল হামলা।
নতুন অভিযোগ: হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে নজরদারি?
সম্প্রতি ইরানে একাধিক সামরিক কর্মকর্তার পরিবার থেকে দাবি করা হয়েছে, ইসরায়েল হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেই লোকেশন ট্র্যাক করছে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম নাগরিকদের হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছে।
আহত সেনা কর্মকর্তা আলি শাদমানির কন্যা মাহদিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বলেন, “আমার বাবা স্মার্টফোন ব্যবহার করতেন না, প্রতি কয়েক ঘণ্টা পরপর অবস্থান পরিবর্তন করতেন। তবুও তাকে টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছে।”
ইরানের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা জোরদার, তবুও ব্যর্থতা
আলি শাদমানি ইরানের খাতাম আল-আনবিয়া সেন্ট্রাল হেডকোয়ার্টারের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার চার দিনের মধ্যেই নিহত হন। তার পূর্বসূরি আলি রাশিদও একইভাবে নিহত হন।
এই ঘটনাগুলো স্পষ্ট করে যে, নিরাপত্তা জোরদার করেও ইসরায়েলের গোপন নজরদারি ও হামলা রোধ করতে পারেনি ইরান।
মোসাদের ‘স্মার্ট’ অস্ত্র: বেডরুম লক্ষ্য করে মিসাইল!
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল এমন এক প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে যা শত্রুর শুধু লোকেশনই নয়, বরং ঘরের নির্দিষ্ট অংশ—যেমন বেডরুম পর্যন্ত শনাক্ত করতে সক্ষম। এমন স্পর্শকাতর প্রযুক্তি তৈরি করতে দুই বছরের বেশি সময় লেগেছে।
রামি ইগ্রা বলেন, “আমরা জানতাম তারা কোন ঘরে ঘুমাচ্ছে। সেই ঘরেই সরাসরি মিসাইল হানা দেওয়া হয়েছে। এটাই প্রযুক্তির শক্তি।”
এ ঘটনায় কী বোঝা যাচ্ছে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, মোসাদের কৌশলগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে—যেখানে আগাম গোয়েন্দা তথ্যের ওপর নির্ভর করেই পরমাণু স্তরের হামলা চালানো সম্ভব। তবে এ ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়েও রামি ইগ্রা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তার মতে, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে, তাহলে এর দায়ভার পড়বে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর ওপর—কারণ তারাই ইরানকে পরমাণু চুক্তি থেকে সরিয়ে দিয়েছে।
ইরানের প্রতিক্রিয়া কী?
এই সিরিজ হত্যাকাণ্ডে ইরানের সামরিক ও গোয়েন্দা মহলে বড়সড় ঝাঁকুনি লেগেছে। তবে এখনো ইরান সরাসরি প্রতিশোধমূলক হামলায় যায়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান ধৈর্য ধরছে এবং আরও বড় কোনো পাল্টা কৌশলের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ইসরায়েল-মোসাদের এই পরিকল্পিত টার্গেট কিলিং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বাস্তবতা নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রশ্ন হলো—প্রযুক্তির এই দাপটের যুগে, নিরাপত্তা আসলে কতটা সম্ভব?
এম আর এম – ০২৩৯, Signalbd.com