আঞ্চলিক

রিলস বানানোর সময় যমুনায় ডুবে ৬ কিশোরীর মৃত্যু

ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের আগ্রা জেলার সিকান্দরা থানার অন্তর্গত এলাকায় যমুনা নদীতে গোসল করতে গিয়ে ছয় কিশোরী মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রিলস (সংক্ষিপ্ত ভিডিও) বানাতে গিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে।

এই ঘটনাটি শুধু একটি দুঃখজনক মৃত্যুর পরিসংখ্যান নয়, বরং এটি একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকেও সামনে নিয়ে আসে—বর্তমান প্রজন্মের সামাজিক মাধ্যম-নির্ভরতা এবং সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সুরক্ষা সচেতনতার অভাব।

ঘটনা যেভাবে ঘটল

গতকাল, মঙ্গলবার দুপুর নাগাদ স্থানীয় সময়ে ছয় কিশোরী কাছাকাছি একটি কৃষি জমিতে কাজ শেষে বিশ্রামের জন্য যমুনা নদীর তীরে আসে। ভারতের সরকারি সংবাদমাধ্যম ও এনডিটিভির বরাত দিয়ে জানা গেছে, তারা নদীর তীরে বসে রিলস বানাতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে শরীর ঠাণ্ডা করতে গিয়ে নদীতে নামে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রথমে তারা পানির ধারে খেলছিল এবং নিজেদের মধ্যে ভিডিও ধারণে ব্যস্ত ছিল। ধীরে ধীরে তারা নদীর আরও গভীরে চলে যায় এবং হঠাৎ স্রোতের টানে পড়ে যায়। এরপর তারা চিৎকার করলেও আশপাশে সাহায্যের কেউ না থাকায় তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ঘটনাস্থলেই চারজন ডুবে যায়, বাকি দুইজনকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় তারাও প্রাণ হারায়।

শোকস্তব্ধ পরিবার ও গ্রামবাসী

মৃত ছয় কিশোরীর সবাই ছিল একই গ্রামের বাসিন্দা। তাদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। হঠাৎ করে এমন একসঙ্গে ছয়টি প্রাণহানির ঘটনায় পুরো গ্রামেই নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া। কিশোরীদের এক স্বজন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন,

“ওরা কাজ শেষ করে একটু বিশ্রাম নিতে গিয়েছিল। গরমে কাহিল হয়ে পড়েছিল সবাই। যে নদী আমাদের জীবিকা দেয়, সেই নদীই আজ ছয়টি প্রাণ নিয়ে নিল।”

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই এলাকায় যমুনা নদীর স্রোত সবসময়ই প্রবল থাকে, বিশেষত গ্রীষ্ম মৌসুমে পানি কমে গেলেও স্রোতের তীব্রতা থাকে প্রচণ্ড। এর আগে সেখানকার বেশ কয়েকজন শিশু ও কিশোর-কিশোরী একইভাবে প্রাণ হারিয়েছে, তবে একসঙ্গে ছয়জনের মৃত্যুর ঘটনা নজিরবিহীন।

প্রশাসনের ভূমিকা ও প্রতিক্রিয়া

ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় স্থানীয় পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। প্রাথমিক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে জানা গেছে, নদীর তীরে কোনোরকম সুরক্ষামূলক নির্দেশনা বা সতর্কীকরণ বোর্ড ছিল না। এমনকি স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ওই নদীপাড়ে কোন নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়নি।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে,

“আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করেছি। মৃতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি এবং সকলকে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ সাহায্য প্রদান করা হবে। একই সঙ্গে কীভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটল, তা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু হয়েছে।”

নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা এবং নদীপাড়ে কোনো রকম নজরদারির অভাব ছিল কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছে প্রশাসন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রবণতা ও বিপদ

এই মর্মান্তিক ঘটনা আবারও প্রশ্ন তোলে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির পরিণতি নিয়ে। রিলস বা শর্ট ভিডিও তৈরির জন্য কতটা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে তরুণরা, সেই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। বিশেষত জলাধারের নিকটবর্তী এলাকা, পাহাড়ি অঞ্চল বা অন্যান্য বিপজ্জনক স্থানগুলিতে ভিডিও বানাতে গিয়ে অনেক সময়ই ঘটছে প্রাণহানি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য তরুণদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক ধরনের ‘ভাইরাল হতে হবে’ মনোভাব। এই মনোভাব কখনো কখনো বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে, যেমনটি দেখা গেল আগ্রার এই ঘটনায়।

ভারতের বিভিন্ন শিশু অধিকার সংগঠন এবং শিক্ষাবিদরা এই ঘটনার পর সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা কর্মসূচির পরামর্শ দিয়েছেন।

স্থানীয়দের আহ্বান

এই দুর্ঘটনার পর স্থানীয় বাসিন্দারা নদীর পাড়ে সুরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করার দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেন, এই এলাকায় বারবার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তারা আশাবাদী, এই ঘটনা প্রশাসনকে আরও দায়িত্বশীল করে তুলবে এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন ট্র্যাজেডি না ঘটে, সে জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

শেষকথা

যমুনার জলে বিলীন হয়ে যাওয়া এই ছয়টি তাজা প্রাণ শুধুমাত্র একটি স্থানীয় বা জাতীয় শোক নয়, বরং এটি আমাদের সমাজে চলমান এক গভীর সমস্যার প্রতিফলন। তরুণ প্রজন্মের অনিয়ন্ত্রিত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার, নিরাপত্তাহীনতা এবং প্রশাসনিক অবহেলা—এই তিনের মিলিত প্রভাবেই প্রাণ গেল এই ছয় কিশোরীর।

এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রযুক্তির ব্যবহার যতই হোক আধুনিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তার সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতা ছাড়া তা হয়ে উঠতে পারে প্রাণঘাতী।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button