বিশ্ব

প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র না থাকায় আড়াই লাখ হজযাত্রীকে মক্কায় প্রবেশে বাধা

সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ এ বছর কঠোর নজরদারি আরোপ করেছে হজযাত্রীদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। সেই লক্ষ্যে, হজে আসা প্রায় ২ লাখ ৬৯ হাজার মুসল্লিকে প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র না থাকায় পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। হজ মৌসুমে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির প্রশাসন।

২০২৪ সালের হজে চরম তাপদাহে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১ হাজার ৩০০-এর বেশি হজযাত্রী। সেই মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতেই এবার সৌদি সরকার আগেভাগেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। সরকার বলছে, হজযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ‘নো পারমিট, নো হজ’ নীতিতে অনড় রয়েছে তারা।

চরম গরমে মৃত্যু রোধই প্রধান উদ্দেশ্য

সৌদি আরবের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ও মিডল ইস্ট আই-এর বরাতে জানা গেছে, গত বছর মক্কার তাপমাত্রা রেকর্ড ৫১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল, যা ইতিহাসে অন্যতম সর্বোচ্চ। অতিরিক্ত গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন হাজার হাজার হজযাত্রী।

এ বছরও গরমের আশঙ্কা রয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, চলমান হজ মৌসুমে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাই তাপজনিত রোগ, বিশেষত হিটস্ট্রোক এড়াতে হজসংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা ও প্রবেশের ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে কঠোর পদক্ষেপ।

হজের প্রস্তুতি: ৫০ হাজারের বেশি স্বাস্থ্যকর্মী মোতায়েন

সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হজ মৌসুমে সম্ভাব্য রোগব্যাধির চিকিৎসা ও দ্রুত সাড়া দিতে তারা আগে থেকেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। ৫০ হাজারের বেশি চিকিৎসক, নার্স ও প্রশাসনিক কর্মী মোতায়েন করা হয়েছে, যারা পুরো হজ মৌসুমজুড়ে কাজ করবেন।

স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী ড. আবদুল্লাহ আসিরি জানিয়েছেন, “আমরা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত। বিশেষ করে, চরম তাপমাত্রাজনিত অসুস্থতা আমাদের প্রধান উদ্বেগ।” তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যে ৪৪ জন হজযাত্রী হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন, যাঁদের যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া, গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জন্য ভেন্টিলেটর সুবিধাসম্পন্ন ৭০০-এর বেশি হাসপাতালের শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে, যাতে দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়।

‘নো পারমিট, নো হজ’—শৃঙ্খলা রক্ষায় জিরো টলারেন্স

সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং হজ ও ওমরাহ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যৌথ নজরদারিতে দেশের অভ্যন্তর ও আন্তর্জাতিক হজযাত্রীদের প্রতি কড়া নজর রাখা হচ্ছে। অনুমতিপত্র ছাড়া মক্কায় প্রবেশের চেষ্টা করলে গ্রেপ্তার এবং শাস্তির বিধান রয়েছে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মোট ২ লাখ ৬৯ হাজার হজযাত্রীকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাঁদের কাছে কোনো অনুমতিপত্র বা হজ-ভিসা ছিল না। অনেকেই স্থানীয়ভাবে ওমরাহ ভিসায় এসে হজে অংশ নিতে চেয়েছিলেন, যা হজ আইনের পরিপন্থী।

১৫ লাখের বেশি হজযাত্রী এরই মধ্যে মক্কায়

সৌদি সরকারের হিসাব অনুযায়ী, এই বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ লাখ মুসল্লি হজে অংশ নিচ্ছেন, যার মধ্যে ১৫ লাখের বেশি মুসল্লি ইতিমধ্যেই মক্কা নগরীতে পৌঁছেছেন

আগামীকাল বুধবার (৫ জুন) থেকে শুরু হচ্ছে হজের আনুষ্ঠানিকতা। এরইমধ্যে কাবা শরিফ ঘিরে বিভিন্ন প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। মিনায় তাঁবু, আরাফার ময়দান, মুজদালিফা ও জামারায় নিরাপত্তা এবং লজিস্টিক সুবিধা জোরদার করা হয়েছে।

যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি হজযাত্রী

২০২৫ সালে হজ পালনের জন্য যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি মুসল্লি গেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছে:

  • ইন্দোনেশিয়া: প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার
  • পাকিস্তান: ১ লাখ ৭৯ হাজার
  • ভারত: ১ লাখ ৭৫ হাজার
  • বাংলাদেশ: ১ লাখ ২৭ হাজার
  • মিসর, তুরস্ক ও নাইজেরিয়া থেকেও লক্ষাধিক হজযাত্রী অংশ নিচ্ছেন।

বাংলাদেশ হজ অফিস জানিয়েছে, বাংলাদেশি হজযাত্রীদের মধ্যে অধিকাংশ ইতিমধ্যে মক্কা ও মদিনায় পৌঁছে গেছেন, এবং নিয়ম অনুযায়ী হজ কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন।

বিশ্বজুড়ে নজরদারি ও সচেতনতা বৃদ্ধি

মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় জমায়েত হজ—তাই একে কেন্দ্র করে সৌদি আরব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রতি বছর। এবার বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও বৈধতা ইস্যুতে।

হজ পালনকারীদের জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অ্যাপ, তাপমাত্রা সতর্কতা বার্তা, অনলাইন পারমিট যাচাই ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এ বছর বিশেষভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে বয়স্ক ও অসুস্থ হজযাত্রীদের নিরাপত্তায়

প্রচণ্ড গরমে যেন আর কোনো প্রাণ না ঝরে পড়ে, সে লক্ষ্যে সৌদি আরবের এই পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। তবে অনেক হজযাত্রী বৈধতা সম্পর্কে সচেতন না থাকায় শেষ মুহূর্তে বাধার মুখে পড়ছেন। তাই মুসলিম দেশগুলোর উচিত, আগাম প্রচারণা ও নিবন্ধন প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও ব্যাপক করা, যেন কেউ হজে গিয়ে ফিরে না আসেন হতাশ হয়ে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button