গাজ্জা পুনর্দখলে এক লাখ সেনা নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরাইল

ফিলিস্তিনের গাজ্জা উপত্যকায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ইসরাইল এক অভূতপূর্ব সামরিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, অবৈধ দখলদার রাষ্ট্র ইসরাইল ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ পর্যন্ত সেনার রিজার্ভ ফোর্স গাজ্জা অভিযানে নামাতে পারে। এই তথ্য প্রকাশের পর মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে যুদ্ধের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
মিডল ইস্ট মনিটরের প্রতিবেদন
বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) ব্রিটেনভিত্তিক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট মনিটর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইসরাইলি সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই সম্ভাব্য রিজার্ভ ফোর্স মোতায়েনের প্রাথমিক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এই তথ্যের উৎস হিসেবে তারা তুর্কি সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সি–এর বরাত দিয়েছে।
আনাদোলুর প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজ্জা পুনর্দখল পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইসরাইলি সেনারা পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছে, এবং এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটি হবে সবচেয়ে বড় সামরিক মোতায়েনগুলোর একটি।
ইসরাইলি সেনা কাঠামোর পরিবর্তন
ইসরাইলের প্রভাবশালী দৈনিক ইয়েদিওথ আহরোনোথ জানিয়েছে, দেশটির চিফ অফ স্টাফ ইয়াল জামির সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর গাজ্জা দখল পরিকল্পনার প্রধান কাঠামো অনুমোদন দিয়েছেন। এর পরপরই হাজার হাজার সেনাকে রিজার্ভ ডিউটির জন্য ডাক দেওয়া হয়েছে।
সেনাদের জন্য একটি বিশেষ আদেশও জারি হয়েছে, যাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, তারা “দ্রুত প্রস্তুত” থাকবে এবং যে কোনো মুহূর্তে অভিযানে যোগ দিতে হবে।
নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার অনুমোদন
গত সপ্তাহে ইসরাইলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা আনুষ্ঠানিকভাবে নেতানিয়াহুর “গাজ্জা পুনর্দখল” পরিকল্পনা অনুমোদন দেয়। এই অনুমোদনের খবর প্রকাশের পর থেকেই আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তুরস্ক, কাতার এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, গাজ্জায় নতুন করে পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযান চালানো মানে আরও রক্তপাত, ধ্বংস এবং মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনা।
আগামী দিনের পরিকল্পনা
ইসরাইলি সূত্রগুলো জানাচ্ছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা আবার বৈঠক করবে, যেখানে এই অভিযানের বিস্তারিত সময়সূচি, টার্গেট এলাকা এবং যুদ্ধ কৌশল চূড়ান্ত করা হবে।
প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, যদি এই অভিযান শুরু হয়, তবে এটি ২০২৬ সালের শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
গাজ্জা যুদ্ধে ভয়াবহ প্রাণহানি
প্যালেস্টাইন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, চলমান গাজ্জা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬১ হাজার ৭০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই শিশু ও নারী।
জাতিসংঘ বলছে, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, কারণ ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া অনেক মানুষের লাশ এখনো উদ্ধার করা যায়নি।
আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়া
২০২৪ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (ICC) ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। অভিযোগ— তারা গাজ্জায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত।
একই সময়ে আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালতেও (ICJ) ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা চলছে। দক্ষিণ আফ্রিকা এই মামলা দায়ের করে এবং বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র প্রকাশ্যে এই মামলার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মন্তব্য
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইলের এই পরিকল্পনা কেবল সামরিক অভিযান নয়, বরং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ওপর দীর্ঘমেয়াদী দখলদারিত্বের নতুন ধাপ।
তাদের মতে, ১ লাখ সেনা নামানো মানে কেবল যুদ্ধ নয়, বরং প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলে দীর্ঘ সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।
গাজ্জা অবরোধের প্রেক্ষাপট
২০০৭ সাল থেকে গাজ্জা ইসরাইলি অবরোধে রয়েছে। স্থল, জল এবং আকাশপথে কঠোর নিয়ন্ত্রণের ফলে গাজ্জাবাসীরা প্রায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় খোলা কারাগারে বসবাস করছে বলে জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো উল্লেখ করেছে।
এই অবরোধের ফলে গাজ্জায় খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি ও নির্মাণসামগ্রীর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, সেখানে এখন মানবিক পরিস্থিতি “অসহনীয়” পর্যায়ে পৌঁছেছে।
মানবাধিকার সংস্থার সতর্কবার্তা
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ শীর্ষ মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, গাজ্জায় নতুন করে পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযান চালানো “যুদ্ধাপরাধের সমতুল্য” হবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক স্পষ্ট করে বলেছেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে গাজ্জায় যে কোনো সামরিক অভিযান আরও অসংখ্য বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ঘটাবে, যা আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী।”
আঞ্চলিক রাজনীতির প্রভাব
এই সংঘাত শুধু গাজ্জা বা ইসরাইল–ফিলিস্তিন ইস্যুতেই সীমাবদ্ধ নয়। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী এবং ইরানও এ বিষয়ে কৌশলগত অবস্থান নিচ্ছে।
অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন, গাজ্জায় পূর্ণাঙ্গ অভিযান শুরু হলে এটি মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।
ইসরাইলি সমাজে বিভক্তি
ইসরাইলি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও এই পরিকল্পনা নিয়ে মতবিরোধ আছে। অনেক প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদ মনে করছেন, গাজ্জায় দীর্ঘস্থায়ী দখল ইসরাইলের জন্য এক “অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক আত্মঘাতী পদক্ষেপ” হতে পারে।
তারা বলছেন, দীর্ঘ সময় ধরে গাজ্জা দখল মানে আন্তর্জাতিক চাপ, অর্থনৈতিক অবরোধ, এবং ইসরাইলি সমাজে আরও গভীর বিভক্তি তৈরি হওয়া।
ফিলিস্তিনিদের প্রতিক্রিয়া
গাজ্জা ও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিরা বলছেন, তারা তাদের ভূমি রক্ষায় শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন। হামাস ও অন্যান্য প্রতিরোধ সংগঠন ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে যে, গাজ্জায় ইসরাইলি সেনাদের জন্য এটি হবে “নরকে প্রবেশ”।
সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ চিত্র
যদি ১ লাখ সেনা মোতায়েন হয়, তবে গাজ্জায় যুদ্ধের তীব্রতা বহুগুণে বেড়ে যাবে। অবকাঠামো ধ্বংস, প্রাণহানি, এবং শরণার্থী সংকট এমন মাত্রায় পৌঁছাতে পারে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়েও দেখা যায়নি।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNRWA) আশঙ্কা করছে, নতুন অভিযান শুরু হলে অন্তত ১০ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়বে।
MAH – 12334 , Signalbd.com