আবহাওয়া

ইতালির মাউন্ট এটনায় ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত: ছাই, গ্যাস ও লাভার তাণ্ডব

ইতালির সিসিলিতে অবস্থিত মাউন্ট এটনা পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় আগ্নেয়গিরি হিসেবে পরিচিত। তবে সোমবার (২ জুন) এটনার অগ্ন্যুৎপাত যেন তার ইতিহাসের ভয়াবহতাকেই ছাপিয়ে গেছে। হঠাৎ এক বিশাল বিস্ফোরণ ও ভূমিধসের ফলে এই প্রাচীন আগ্নেয়গিরির দক্ষিণ-পূর্ব ঢালে সৃষ্টি হয় বিপজ্জনক পরিস্থিতি, যেটি স্থানীয় বাসিন্দা, পর্যটক এবং ভূবিজ্ঞানীদের নতুন করে আতঙ্কিত করে তুলেছে।

হঠাৎ ধস ও অগ্ন্যুৎপাত: ছড়াল গরম গ্যাস ও ছাই

স্থানীয় সময় দুপুরের দিকে মাউন্ট এটনার দক্ষিণ-পূর্ব অংশে আচমকা ধস নামে। এরপরই সেখানে ঘটে একটি প্রবল বিস্ফোরণ। এ বিস্ফোরণে কয়েক কিলোমিটার উচ্চতায় গরম গ্যাস, ছাই ও পাথরের টুকরো ছড়িয়ে পড়ে আকাশে। অগ্ন্যুৎপাতের পরপরই বিশাল এলাকা ঢেকে ফেলে ছাইয়ের কুয়াশা, যা কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে দৃশ্যমান ছিল।

বিশ্ববিখ্যাত সংবাদমাধ্যম সিএনএনের বরাতে জানা যায়, এই অগ্ন্যুৎপাত ছিল ২০১৪ সালের পর এটনার সবচেয়ে শক্তিশালী অগ্ন্যুৎপাতগুলোর একটি। ইতালির জাতীয় ভূতত্ত্ব ও আগ্নেয়গিরি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (INGV) জানিয়েছে, বিস্ফোরণের ফলে যে লাভা বের হয়, তা দক্ষিণ-পূর্ব অংশে কয়েকশ’ মিটার পর্যন্ত গড়িয়ে পড়ে, তবে এখন সেটি ঠান্ডা হয়ে আসছে।

পর্যটকদের প্রাণরক্ষা, গাইডদের সাহসী ভূমিকা

এসময় মাউন্ট এটনায় ট্রেকিংয়ে থাকা বহু পর্যটক ও পর্বতারোহী আতঙ্কিত হয়ে নিচের দিকে দৌড়ে পালিয়ে আসেন। অনেকেই প্রাণে বেঁচে যান তাদের সঙ্গে থাকা অভিজ্ঞ গাইডদের তৎপরতায়।

এক পর্যটক গাইড, জুসেপ্পে পানফালো, তার গ্রুপের সদস্যদের নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে সরে যাওয়ার সময় একটি ভিডিও ধারণ করেন। ভিডিওতে দেখা যায়, ধোঁয়া ও ছাইয়ের বিশাল মেঘ তাদের পেছনে ধেয়ে আসছে। তিনি বলেন, “আমরা প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলাম। গাইড না থাকলে হয়তো প্রাণে বাঁচা সম্ভব হতো না।”

অন্য এক গাইড আলেসিও জোকো জানান, “বিস্ফোরণটি ছিল হঠাৎ এবং ভয়াবহ, কিন্তু ভাগ্যক্রমে এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মুহূর্তটি ছিল অবিশ্বাস্য, একদিকে ভয়াবহতা আর অন্যদিকে প্রাকৃতিক শক্তির ভয়ংকর সৌন্দর্য।”

স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য আপাতত ঝুঁকি নেই

সিসিলির গভর্নর রেনাতো শিফানি নিশ্চিত করেছেন, “এই অগ্ন্যুৎপাত স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য বড় কোনো ঝুঁকি তৈরি করেনি। তবে আগ্নেয়গিরির শীর্ষ এলাকাগুলো এখন বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাই পর্বতারোহীদের শীর্ষে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে জরুরি পরিষেবা প্রস্তুত আছে। স্থানীয় সড়কগুলো জরুরি যানবাহনের জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছে।”

ফ্লাইট ও যাতায়াতে সাময়িক পরিবর্তন

মাউন্ট এটনার বিস্ফোরণ ও ছাইয়ের কারণে কিছু ফ্লাইটে প্রভাব পড়েছে। কাতানিয়া ও পালেরমো বিমানবন্দর এখনো খোলা থাকলেও নিরাপত্তার খাতিরে কিছু ফ্লাইট পালেরমো থেকে অন্যত্র ডাইভার্ট করা হয়েছে।

ইতালির বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, “বায়ুমণ্ডলে ছাইয়ের পরিমাণ ও গতিপ্রবাহের উপর নির্ভর করে ভবিষ্যতে ফ্লাইটের সময়সূচিতে পরিবর্তন আনা হতে পারে।”

বিস্ফোরণের শব্দ কানে পৌঁছেছে ৫০ কিলোমিটার দূরেও

এটনার বিস্ফোরণের শব্দ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, ৫০ কিলোমিটার দূরের শহর তাওরমিনা ও ৪০ কিলোমিটার দূরের কাতানিয়াতেও তা শোনা গেছে। আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে বাড়িঘর সাময়িকভাবে কেঁপে ওঠে, যদিও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।

বাতাসে ছাই ও গ্যাসের বিস্তার: স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সতর্কতা

বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এমন অগ্ন্যুৎপাত সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয় না, তবে ছাই ও গ্যাস নিঃসরণ কয়েকদিন পর্যন্ত চলতে পারে। বাতাসের গতি যদি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে থাকে, তবে কাতানিয়া শহর ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

কাতানিয়ার মেয়র বলেন, “আমরা শহরবাসীকে যথাযথ সতর্কতা দিচ্ছি এবং প্রয়োজন হলে জরুরি স্বাস্থ্য নির্দেশনা জারি করব। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্তদের বাড়ির বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।”

বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় আগ্নেয়গিরি মাউন্ট এটনা

মাউন্ট এটনা বিশ্বের সবচেয়ে সক্রিয় আগ্নেয়গিরির একটি। এটি সিসিলি দ্বীপে অবস্থিত এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয়বস্তু। প্রায় প্রতি বছরই এটনায় ছোট থেকে মাঝারি অগ্ন্যুৎপাত ঘটে, তবে এবারের ঘটনাটি ব্যতিক্রম এবং ভয়াবহতায় ২০১৪ সালের ঘটনার স্মৃতিকে সামনে নিয়ে এসেছে।

ভবিষ্যৎ কী বলছে বিজ্ঞানীরা?

ইতালির ভূবিজ্ঞানী দল জানাচ্ছেন, ধসে পড়া দক্ষিণ-পূর্ব ক্রেটার এটি আরও সক্রিয় করতে পারে। তবে বর্তমানে লাভা প্রবাহ কমছে এবং তা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। তারা আরও জানিয়েছেন, “বর্তমানে বিপদের সম্ভাবনা কম, তবে পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখা হবে। নতুন করে গ্যাসের চাপ বা ভিতরের ক্রেটারে পরিবর্তন হলে আগ্নেয়গিরিটি আবার জেগে উঠতে পারে।”

প্রকৃতির রুদ্র রূপের সামনে মানুষ কতটা অসহায়!

মাউন্ট এটনায় এবারের অগ্ন্যুৎপাত শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি আবারও মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির ভয়ংকর শক্তি কতটা অনিশ্চিত ও অপ্রতিরোধ্য। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা যত উন্নতই হোক না কেন, এমন ঘটনার মুখোমুখি হয়ে মানুষ বারবার প্রমাণ পায়— প্রকৃতির সামনে আমরা এখনো ক্ষুদ্র।

তবে ইতালির প্রস্তুতি, পর্যবেক্ষণ ও দ্রুত সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা এই দুর্যোগকে বড় বিপর্যয়ে রূপ নিতে দেয়নি। আগাম সতর্কতা ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা থাকলে প্রকৃতির রুদ্র রূপকেও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব— মাউন্ট এটনা তারই প্রমাণ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button