২০০ বিলিয়ন ডলার সম্পদের সিংহভাগ আফ্রিকায় দান করার ঘোষণা দিলেন বিল গেটস

মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি বিল গেটস আবারও দানশীলতার নতুন ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন। আগামী ২০ বছরের মধ্যে নিজের প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদের একটি বড় অংশ আফ্রিকার স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাখাতে ব্যয় করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। সোমবার ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় আফ্রিকান ইউনিয়নের সদর দপ্তরে এক ভাষণে এ ঘোষণা দেন গেটস।
বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দানবীর গেটস বলেন, “সরকারের সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এই তহবিল ব্যবহার করা হবে, যাতে প্রকৃত প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব হয়।”
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টিতে জোর
গেটস তাঁর বক্তব্যে বিশেষভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং মাতৃ ও শিশুপুষ্টির উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, “আমরা দেখেছি, একজন মাকে গর্ভধারণের আগে, গর্ভাবস্থায় এবং সন্তানের জন্মের পর পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও পুষ্টি নিশ্চিত করা গেলে সবচেয়ে ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। শিশুর প্রথম চার বছরের পুষ্টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি আরও বলেন, “স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি আফ্রিকান দেশই সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে, এবং এই যাত্রায় অংশ নেওয়া আমার কাছে অত্যন্ত রোমাঞ্চকর।”
স্বাস্থ্যখাতে নির্ভরতা ও নবায়নের প্রশংসা
গেটস তাঁর বক্তব্যে আফ্রিকার কয়েকটি দেশের সরকার ও স্বাস্থ্য নীতিনির্ধারকদের প্রশংসা করেন। বিশেষভাবে ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা, জিম্বাবুয়ে, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া এবং জাম্বিয়ার সাহসী নেতৃত্বকে কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
এই দেশগুলো ম্যালেরিয়া, এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ, টিকাদান কর্মসূচি ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে বলেই মনে করেন গেটস।
তাঁর ভাষায়, “অফুরন্ত পরিশ্রম, সীমিত সম্পদের মাঝেও উদ্ভাবন, এবং প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে সেবা পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা আমাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে।”
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) দিয়ে স্বাস্থ্যখাতে বিপ্লব
আফ্রিকার স্বাস্থ্যখাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গেটস বলেন, “মোবাইল ব্যাংকিং বিপ্লবের মতো, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) আফ্রিকার স্বাস্থ্যসেবাতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে।”
তিনি রুয়ান্ডার উদাহরণ দিয়ে বলেন, “রুয়ান্ডা ইতোমধ্যেই এআই চালিত আল্ট্রাসাউন্ড প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা শনাক্ত করছে। এর ফলে অনেক মাকে সময়মতো জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।”
বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের পরিকল্পনা
গেটসের এই বিশাল প্রতিশ্রুতি বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের একটি অংশ। ফাউন্ডেশনের প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, “বিল গেটস ইথিওপিয়া ও নাইজেরিয়ায় সরেজমিন পরিদর্শনে যাবেন এবং বিদেশি সাহায্য হ্রাসের প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন অগ্রাধিকারগুলো কীভাবে ঠিক রাখা যায়, তা দেখবেন।”
এছাড়াও, আগামী ২০ বছরে ফাউন্ডেশন আফ্রিকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপকহারে বিনিয়োগ করবে। এর মধ্যে রয়েছে:
- মাতৃ ও শিশুপুষ্টি কর্মসূচি
- টিকাদান কার্যক্রম
- প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা উন্নয়ন
- AI প্রযুক্তি দিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার রূপান্তর
- চিকিৎসাসেবা ডিজিটালাইজেশন
- কর্মী উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রাম
বিদেশি সাহায্য হ্রাসের প্রেক্ষাপটে গেটসের পদক্ষেপ
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশি সাহায্য ও দাতা সহায়তা ক্রমশ কমে আসছে, যা আফ্রিকার স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ঠিক এই সময়ে গেটসের মতো একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তাঁর ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এমন দান প্রতিশ্রুতি আফ্রিকান দেশগুলোর জন্য নতুন আশার বার্তা।
বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে আফ্রিকার স্বাস্থ্যখাতে বৈদেশিক সহায়তা ১৫ শতাংশ কমেছে। এই ঘাটতি পূরণে ব্যক্তিগত দান, জন–বেসরকারি অংশীদারিত্ব এবং টেকসই বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
দানশীলতায় বিল গেটসের অতীত রেকর্ড
উল্লেখ্য, বিল গেটস এর আগেও তাঁর সম্পদের একটি বড় অংশ দান করেছেন। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ইতোমধ্যে সারা বিশ্বে প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যার একটি বড় অংশ স্বাস্থ্য, টিকাদান, দারিদ্র্য হ্রাস ও কৃষিক্ষেত্রে গেছে।
২০২২ সালে গেটস ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি ধাপে ধাপে তাঁর সম্পদের প্রায় সবটাই দান করে দেবেন এবং ভবিষ্যতে বিশ্বের ধনী তালিকায় তাঁর অবস্থান না-ও থাকতে পারে। এবার তাঁর আফ্রিকান উদ্যোগ সেই প্রতিশ্রুতিরই বাস্তব রূপ।