গাজার মানুষকে পরিকল্পিতভাবে অনাহারে রাখা হচ্ছে

গাজায় চলমান মানবিক সংকট নিয়ে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিভাগের প্রধান টম ফ্লেচারের মন্তব্যে বিশ্বব্যাপী নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ফ্লেচার সোজাসাপ্টা ভাষায় বলেছেন, “ইসরায়েলি নীতির কারণেই গাজার মানুষ আজ জোরপূর্বক অনাহারের শিকার হচ্ছেন।” বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একে সম্ভাব্য “যুদ্ধাপরাধ” বলেও উল্লেখ করেছেন।
গাজার লাখ লাখ ফিলিস্তিনির জন্য এই পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন। যদিও সম্প্রতি কিছুটা অবরোধ শিথিল করে ত্রাণ সরবরাহের সুযোগ দিয়েছে ইসরায়েল, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এদিকে ইসরায়েলের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের দেওয়া কিছু বক্তব্যে এই মানবিক সংকট যে ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্টি করা হচ্ছে, সে আভাস মিলেছে।
টম ফ্লেচারের সরাসরি অভিযোগ: সীমান্তে খাবার আছে, গাজায় নেই
জাতিসংঘ কর্মকর্তা ফ্লেচার বলেন, “আমরা দেখছি সীমান্তে খাবার রাখা আছে, কিন্তু গাজার ভিতরে লাখো মানুষ অনাহারে কষ্ট পাচ্ছে। সেখানে এই খাদ্য পৌঁছাতে দেওয়া হচ্ছে না। এটা শুধু ত্রাণ বিলম্ব নয়, এটা রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা শুনেছি, ইসরায়েলি মন্ত্রীরা সরাসরি বলেছেন, এই খাদ্য আটকে রাখার উদ্দেশ্য হলো গাজার মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যাতে তারা নিজেদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।”
এই পরিস্থিতিকে তিনি মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, যদি ইচ্ছাকৃতভাবে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়, তবে তা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এবং যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞায় পড়ে।
‘এটা যুদ্ধাপরাধ’—ফ্লেচারের মন্তব্যে বিশ্বে নড়েচড়ে বসেছে কূটনৈতিক মহল
বিবিসির প্রশ্নের জবাবে টম ফ্লেচার বলেন, “হ্যাঁ, জোরপূর্বক অনাহার যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়ে। অবশ্যই, আদালতই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে, তবে ইতিহাস এই ঘটনার বিচার করবে।”
এই মন্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে দারুণ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশ ইসরায়েলের সামরিক কৌশলের সমালোচনা করছে।
ইসরায়েলি মন্ত্রীর ঘৃণ্য মন্তব্যে ক্ষুব্ধ জাতিসংঘ
সম্প্রতি ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ বলেন, “গাজার মানুষ যেন বুঝতে পারে তাদের জন্য কিছুই নেই। তারা যেন অন্য কোথাও গিয়ে নতুন জীবন শুরু করার কথা ভাবতে বাধ্য হয়।” এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র নিন্দা কুড়িয়েছে।
টম ফ্লেচার এই বক্তব্যকে স্পষ্ট ঘৃণামূলক ও মানবতাবিরোধী বলে আখ্যা দিয়ে বলেন, “ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর উচিত হবে এমন বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পক্ষে বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোকে একসঙ্গে দাঁড়াতে হবে।”
হামাস ও যুদ্ধবিরতির ব্যর্থতা: গাজা উপত্যকায় আবারও হামলা
চলতি বছরের ২ মার্চ থেকে যুদ্ধবিরতির সময়কালেও ইসরায়েল গাজায় কোনো ধরনের ত্রাণ প্রবেশ করতে দেয়নি। প্রায় তিন মাসের অবরোধের পর সীমিত পরিসরে কিছু ত্রাণ ঢোকার অনুমতি দিলেও, ১৮ মার্চ থেকে ফের নির্বিচার বিমান ও স্থল হামলা শুরু হয়।
ইসরায়েলের দাবি, এখনো ৫৮ জন জিম্মি গাজায় আটকে আছে। তাদের মুক্ত করতেই এই চাপ প্রয়োগ চলছে। তবে ধারণা করা হয়, এর মধ্যে অন্তত ২০ জন জীবিত রয়েছেন।
ত্রাণ বিতরণেও বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা
অবরোধ শিথিল করার পর গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন পরিচালিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে অন্তত ৪৭ জন ভিড়ের মধ্যে পড়ে আহত হয়েছেন।
জাতিসংঘ নিজে এই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, কারণ এটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল-সমর্থিত এবং নিরপেক্ষতার ঘাটতি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ফ্লেচারের বিতর্কিত মন্তব্য এবং ক্ষমা
সম্প্রতি টম ফ্লেচার বলেছিলেন, “গাজায় সহায়তা না পৌঁছালে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ১৪ হাজার শিশু মারা যেতে পারে।” পরে জাতিসংঘ এই তথ্য সংশোধন করে। ফ্লেচার পরে স্বীকার করেন, “ভাষা ব্যবহারে নির্ভুলতা জরুরি, বিশেষ করে এমন সংকটময় মুহূর্তে।”
এই স্বীকারোক্তি তাঁকে মানবিকতার পক্ষে একজন দায়িত্বশীল কণ্ঠ হিসেবে তুলে ধরে, যার মূল লক্ষ্য সমস্যা সমাধান এবং গণচেতনা জাগানো।
বিশ্ব নেতাদের প্রতিক্রিয়া: সমালোচনার তীব্রতা বাড়ছে
- ইইউ’র শীর্ষ কূটনীতিক কাজা কালাস বলেছেন, “হামাসের বিরুদ্ধে যতটুকু সামরিক পদক্ষেপ প্রয়োজন, ইসরায়েল তার চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় হামলা চালাচ্ছে।”
- জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎর্স হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “ইসরায়েলের আসল লক্ষ্য কী, সেটা আমরা আর বুঝতে পারছি না।”
- যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা ইসরায়েলকে সামরিক অভিযান বন্ধ এবং গাজায় দ্রুত ত্রাণ সরবরাহের অনুমতি দিতে বলেছে। এর জবাবে নেতানিয়াহু অভিযোগ করেন, এই নেতারা ‘হামাসের পক্ষ নিচ্ছেন।’
অনাহার এখন যুদ্ধের অস্ত্র?
গাজার মানুষের ওপর চলমান সংকট যেন মানবিক বিপর্যয়ের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘ সরাসরি যুদ্ধাপরাধের সম্ভাবনার কথা বলছে, বিশ্ব নেতারা হতবাক, আর গাজার সাধারণ মানুষ অনাহার আর বোমার ভয় নিয়ে প্রতিদিন কাটাচ্ছে।
এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠেছে—“অনাহার কি এখন যুদ্ধের নতুন অস্ত্র?” যদি তাই হয়, তবে তা মানবতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে।