সিরিয়া-ইসরায়েল সরাসরি আলোচনা শুরু: মধ্যপ্রাচ্যে সম্পর্কোন্নয়নের নতুন বার্তা

মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের শত্রু রাষ্ট্র সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি আলোচনা শুরু হয়েছে। সীমান্ত উত্তেজনা কমিয়ে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এই আলোচনা শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট পাঁচজন ব্যক্তি, যারা রয়টার্সকে তথ্য দিয়েছেন। সিরিয়ার ইসলামপন্থী নতুন সরকার ও ইসরায়েলের নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের মধ্যে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে একাধিক গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে বলেও জানা গেছে।
এই আলোচনা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ও পরোক্ষ চাপে শুরু হয়েছে। ওয়াশিংটন চাইছে, সিরিয়ার নতুন শাসকগোষ্ঠী ইসরায়েলের সঙ্গে একটি অন্তত সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলুক। এতে ইসরায়েলও সিরিয়ায় সামরিক অভিযান কমাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে।
গোপন আলোচনা থেকে সরাসরি সংলাপে উত্তরণ
জানা গেছে, এই সংলাপের সূত্রপাত হয় গত ডিসেম্বরে, যখন ইসলামপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (HTS) প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। এরপর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক মধ্যস্থতাকারীর সহায়তায় গোপনে ইসরায়েল ও সিরিয়ার মধ্যে যোগাযোগ চলছিল।
তবে এখন সেই আলোচনাই রূপ নিয়েছে মুখোমুখি বৈঠকে। বিভিন্ন নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে, ইসরায়েল অধিকৃত গোলান মালভূমি ও এর আশপাশের সীমান্তবর্তী এলাকাতেই এই বৈঠকগুলো হয়েছে। যদিও আলোচনার বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউই কথা বলতে রাজি হননি।
কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সিরিয়ার পক্ষ থেকে?
সূত্র জানায়, সিরিয়ার পক্ষ থেকে আলোচনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন আহমাদ আল-দালাতি। আসাদ সরকারের পতনের পর তাকে কুনেইত্রা প্রদেশের গভর্নর করা হয়, যা গোলান মালভূমির সন্নিকটে। সম্প্রতি তাকে সুইদা প্রদেশের নিরাপত্তার দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। সুইদা হচ্ছে দ্রুজ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা, যেখানে ইসরায়েলের কৌশলগত আগ্রহ রয়েছে।
তবে রাষ্ট্রীয় টিভি ইখবারিয়াতে দেওয়া এক বিবৃতিতে দালাতি সরাসরি এই আলোচনায় অংশগ্রহণের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “আমি ইসরায়েলি কোনো পক্ষের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় অংশগ্রহণ করিনি।”
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে কারা আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন?
রয়টার্স নিশ্চিত করতে না পারলেও দুটি সূত্র জানিয়েছে, ইসরায়েলের পক্ষ থেকে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা। তৃতীয় একটি সূত্র আরও জানায়, এই আলোচনায় সংযুক্ত আরব আমিরাতও মধ্যস্থতা করছে, বিশেষ করে উভয় দেশের সীমান্তে যুদ্ধবিরতির পরিবেশ বজায় রাখতে।
শারার বক্তব্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় নাটকীয় মোড়
চলতি মাসের শুরুতে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা স্বীকার করেন, তার দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের পরোক্ষ আলোচনা হয়েছে। তখন তিনি বলেছিলেন, উত্তেজনা প্রশমনে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে এই আলোচনা হয়েছে।
১৪ মে রিয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে শারার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বহু দশকের সিরীয় নীতি থেকে সরে এসে সরাসরি নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করছে—এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে।
এক আঞ্চলিক গোয়েন্দা সূত্র বলেছে, শারার সঙ্গে ট্রাম্পের এই বৈঠক ইসরায়েলের জন্যও একটি সতর্কবার্তা ছিল। কারণ, ইসরায়েল চাইছিল, আসাদ পতনের পর সিরিয়ার অস্থিতিশীলতা তারা কাজে লাগাবে। কিন্তু ট্রাম্প-শারা বৈঠক সেই পরিকল্পনায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গোলান মালভূমির প্রশ্নে সিরিয়ার কৌশলগত অবস্থান
ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। তবে গত ডিসেম্বরে আসাদের পতনের পর ইসরায়েল আরও কিছু সীমান্তবর্তী অঞ্চল দখল করে। ইসরায়েল দাবি করছে, সিরিয়ার নতুন শাসকদের অতীতে উগ্র মতাদর্শ থাকায় এটি তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে করা হয়েছে।
শারা অবশ্য সরাসরি ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলেননি। তবে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, ১৯৭৪ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় গোলান মালভূমিতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি বাফার জোন তৈরির পক্ষে তিনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্ভাব্য সমঝোতার প্রথম ধাপ হতে পারে।
ইসরায়েলি হামলা, ফিলিস্তিন ইস্যু ও সিরিয়ার অবস্থান
সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল সিরিয়ার ভেতরে একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে। এতে দেশটির বহু সামরিক স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। পাশাপাশি ইসরায়েল ওয়াশিংটনের কাছে তদবির চালাচ্ছে, যাতে সিরিয়া দুর্বল থাকে ও ইরানপন্থী গোষ্ঠীগুলো মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে।
এদিকে, সিরিয়ার নতুন নেতৃত্ব নিজেদের গ্রহণযোগ্য প্রমাণ করতে ইসরায়েলের জন্য হুমকি নয়—এই বার্তা দিতে উদ্যোগ নিচ্ছে। তারা সম্প্রতি দামেস্কে ও বিদেশে ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে এবং ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ সংগঠনের দুই নেতাকে আটক করেছে। এই সংগঠনটি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের সঙ্গে মিলে ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল।
নতুন গঠন, পুরোনো শত্রুতা: কী পরিণতি দেখছে বিশ্লেষকরা?
বিশ্লেষকদের মতে, এই আলোচনা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় ইসলামপন্থী নতুন নেতৃত্ব একদিকে পশ্চিমাদের সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরি করছে, অন্যদিকে ইসরায়েলের দৃষ্টিতে নিজেদের ঝুঁকিহীন প্রমাণে সচেষ্ট।
তবে দীর্ঘমেয়াদে ইসরায়েল-সিরিয়ার মধ্যে সম্পর্ক কতটা বাস্তবসম্মত ও টেকসই হবে, তা নির্ভর করছে গোলান মালভূমির মালিকানা, যুদ্ধবিরতি চুক্তির বাস্তবায়ন এবং ফিলিস্তিনি ইস্যুতে সিরিয়ার অবস্থানের ওপর।