বিশ্ব

যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বাণিজ্যযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মানুষেরা

যুক্তরাষ্ট্র–চীন বাণিজ্যযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক অস্থিরতা বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে পর্যটন খাতেও। অনলাইন ট্রাভেল প্ল্যাটফর্ম ট্রিভাগোর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, শুল্কে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পর্যটকেরা এখন যুক্তরাষ্ট্রকে ভ্রমণের তালিকায় রাখছেন না। এ ছাড়াও যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটনে উল্লেখযোগ্য উল্লম্ফন দেখা গেছে।

ট্রাম্প–ট্যারিফ: পর্যটনকে কাঁপিয়ে দেওয়া নীতি

১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, মেক্সিকো ছাড়াও ১৮০–এরও বেশি দেশের উপর শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। যদিও পরে কিছু ক্ষেত্রে ৯০ দিনের জন্য তা স্থগিত রাখা হয়, ‘আলোচনার সুবিধার্থে’ বলে। কিন্তু একবার চাঁদা ঘোষণা হলেই বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়, এবং সেটি পর্যটন ক্ষেত্রেও সংকোচন ডেকে আনে।

ট্রিভাগো–র ভ্রমণ বুকিং বিশ্লেষণ

ট্রিভাগো–র ২০২৫ সালের জানুয়ারি–মে পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বুকিং ডেটা বিশ্লেষণে পাওয়া গেল:

  • জাপান, কানাডা ও মেক্সিকো: মার্কিন ভ্রমণের বুকিং কমেছে দুই অঙ্কের হার
  • জার্মানি: বুকিং পতন এক অঙ্কের মধ্যে, কারণ মারাত্মক শুল্কহুমকি থাকলেও পরে ৫০ শতাংশ শুল্ক স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
  • যুক্তরাজ্য: আপাতত কোনো বড় পরিবর্তন না, কারণ ব্রিটেন ট্রাম্প–এর শুল্কনীতিতে ছিল তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ‘বাই–প্রদান’ অবস্থানে; সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে স্বাধীন বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করেছে।

এই ডেটা থেকে স্পষ্ট, স্থায়ী অস্থিরতার গুঞ্জনই পর্যটককে ভয় দেখায়; শুল্ক শুধুমাত্র বাণিজ্যের নয়, ভ্রমণের মাত্রাকেও প্রভাবিত করে।

ন্যাশনাল ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম অফিসের উদ্বেগ

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম অফিস–এর ২০২৫ সালের মার্চ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক পর্যটকের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় ১১.৬ শতাংশ কমেছে। এর ফলে:

  1. পর্যটন আয় কমে যাচ্ছে, যা ২০২४ সালে ছিল $২.৬ ট্রিলিয়ন (২ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার)।
  2. হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রিটেইল—সব খাতে মাথাচাড়া দিচ্ছে উদ্বেগ।
  3. স্থানীয় সরকারের পর্যটন প্রমোশন বাজেট পুনর্বিবেচনা শুরু।

আমেরিকান পর্যটক: ভ্রমণে সংযম

শুল্ক–অস্থিরতার পাশাপাশি ঘরের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাও আমেরিকান পর্যটকের মনোভাব বদলে দিয়েছে। ট্রিভাগো–র ডেটা অনুযায়ী:

  • সস্তা হোটেলকম তারকা রেটিংবিশিষ্ট আবাসনই এখন জনপ্রিয়।
  • ইউএসএ–ই মধ্যে ছোট Road trip বুকিং বেড়েছে, বিশেষ করে ন্যাশনাল পার্করোড সাইড অ্যাট্রাকশনে
  • সেমিনার ও বিজনেস ট্রাভেল এ সবথেকে কম প্রভাবিত; কারণ কর্পোরেট বাজেট নিরাপদ রেখেই ব্যবসায়িক প্রয়োজন মেটানো হচ্ছে।

প্রতিক্রিয়ায় অভ্যন্তরীণ পর্যটন বৃদ্ধি

জার্মানি, যুক্তরাজ্য ইত্যাদি দেশেই দেখা যাচ্ছে, যতটা আন্তর্জাতিক ভ্রমণ কমছে, অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ কিন্তু বর্ধিত:

  • যুক্তরাজ্য: ২০২৫ সালের জুলাই–সেপ্টেম্বর অভ্যন্তরীণ বুকিং ২৫ শতাংশ বেড়েছে।
  • জার্মানিতে “Staycation” জনপ্রিয়তা পেয়েছে, মানুষ প্রতি উইকেন্ডেই ঘুরতে বের হচ্ছে।
  • জাপান ও কানাডা–তেও অভ্যন্তরীণ পর্যটন বুঝে–বুঝে সিমেটেছে; বিশেষ করে প্রাকৃতিক আকর্ষণে সস্তা পথ খুঁজছে পর্যটক।

ট্রিভাগোর প্রধান নির্বাহী ইয়োহানেস টমাস বলেছেন,

“অস্থিরতার সময় মানুষ ‘ঘরের কাছাকাছি’ থাকতে চায়, যেখানেই বৈশ্বিক সংকট—তাই স্থানীয় পর্যটনে ঝোঁক বাড়ে।”

করোনা পরবর্তী ভ্রমণ খাতের পুনরুদ্ধার

করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ২০২১ সাল থেকে পর্যটন–ভ্রমণ খাত বার্তা ফিরে পেয়েছেট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স–এর তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালে বৈশ্বিক পর্যটক আগমন প্রাক-মহামারি স্তরে ফিরে এসেছে, এবং ২০২৩–এর সংখ্যা ২০১৯–এর ৮৮ শতাংশ ছিল।

  • ২০২3 সালের পর্যটন খাতের অবদান ছিল $9.9 ট্রিলিয়ন (৯৯ লাখ কোটি ডলার), গ্লোবাল GDP–এর প্রায় ১০%।
  • কিন্তু ট্রাম্প–এর শুল্কনীতির কারণে এই পুনরুদ্ধার মন্দা অনাশ্চিত হচ্ছে।

ভবিষ্যৎ প্রবণতা ও সুপারিশ

  1. স্ট্যাটেজি রিজলাই়েন্স: যুক্তরাষ্ট্রের পর্যটন বোর্ডকে বৈশ্বিক অস্থিরতায় দ্রুত ‘ডাইভার্সিফিকেশন’ করতে হবে—নতুন মার্কেট যেমন ভারত, দক্ষিণ আমেরিকা।
  2. কর্পোরেট ইনসেন্টিভ: ব্যবসায়িক ভ্রমণে কর লাঘব, কর্পোরেট ভাউচার ইত্যাদি চালু করা যেতে পারে।
  3. ডোমেস্টিক প্রোমোশন: ‘Staycation’ বা স্থানীয় আকর্ষণ নিয়ে নতুন ক্যাম্পেইন; ন্যাশনাল পার্ক পাস, ফাম টুরিজম ইত্যাদিতে বিনিয়োগ।
  4. চুক্তি ও ব্যবস্থা: ট্রাম্প–পরে বাপ্তি সরকারের শুল্কপলিসি পর্যালোচনা ও ‘পর্যটন সহজতর’ চালু করা জরুরি—ভিসা ছাড়, দ্রুততর নিরাপত্তা চেকপয়েন্ট ইত্যাদি।
  5. টেকনোলজি–সাপোর্ট: পর্যটন খাতে AI–ভিত্তিক বুকিং সিস্টেম, ভার্চুয়াল ট্যুর, ম্যাচিং প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

ব্যবসায়িক শুল্কের ধাক্কা শুধু বাণিজ্যেই সীমাবদ্ধ নেই—পর্যটিত মন ও ভ্রমণ অভ্যাসও প্রভাবিত হয়। ট্রাম্প–এর শুল্কনীতির পরিপ্রেক্ষিতে ট্রিভাগো–র ডেটা বলছে, আন্তর্জাতিক ভ্রমণ সংকীর্ণ হচ্ছে। এই সংকট কাটিয়ে অভ্যন্তরীণ পর্যটনই আপাতত সান্ত্বনা। আমেরিকার মতো পর্যটননির্ভর অর্থনীতির ক্ষেত্রে দ্রুত ‘বিমানপথ–বাণিজ্য’ সংলগ্ন নীতি গড়ে তুলতে না পারলে বাইরের স্থবিরতা থেকে মু্ক্ত প্রাণ ফিরে পেতে দেরি হবে। বর্তমানে বিশ্বপর্যটক ঘরের কাছাকাছি নিরাপদ অভিজ্ঞতার দিকে ঝুঁকছে—এটাই হয়তো ভ্রমণের ভবিষ্যৎ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button