নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে মদ বিক্রির অনুমতি দিচ্ছে সৌদি আরব

সৌদি আরব, যা দীর্ঘদিন ধরে ইসলামি শরিয়াভিত্তিক কঠোর সামাজিক ও আইনি নিয়ম-কানুনের জন্য পরিচিত, এবার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে পৌঁছেছে। দেশটির সরকার সম্প্রতি এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে—আগামী ২০২৬ সাল থেকে সীমিত ও কঠোর নিয়ন্ত্রিত পরিসরে অ্যালকোহল বিক্রির অনুমতি দেওয়া হবে।
এই সিদ্ধান্তকে সৌদি আরবের ‘ভিশন ২০৩০’ রূপকল্পের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে বৈচিত্র্য আনা এবং আন্তর্জাতিক পর্যটন ও বৈশ্বিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করা।
7০ বছরের নিষেধাজ্ঞার অবসান
১৯৫২ সাল থেকে সৌদি আরবে অ্যালকোহল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। এই নিষেধাজ্ঞা ছিল স্থানীয় নাগরিক এবং বিদেশি উভয়ের জন্যই কঠোরভাবে প্রযোজ্য। ইসলামি শরিয়া আইন অনুসারে, অ্যালকোহল পানের উপর নিষেধাজ্ঞা দেশটির আইনের কেন্দ্রীয় একটি উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
কিন্তু ২০২৬ সাল থেকে সৌদি সরকার একটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত লাইসেন্সিং ব্যবস্থার অধীনে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় অ্যালকোহল বিক্রি ও সীমিত ব্যবহারের অনুমতি দেবে। সরকার আশা করছে, এই সীমিত নীতির মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে এবং একইসাথে দেশের ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ বজায় রাখা সম্ভব হবে।
যেসব স্থানে মদের বিক্রির অনুমতি মিলবে
সরকারি সূত্র ও মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, অ্যালকোহল বিক্রির জন্য সৌদি আরব জুড়ে প্রায় ৬০০টি নির্ধারিত স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- পাঁচ তারকা হোটেল
- হাই-এন্ড রিসোর্ট
- কূটনৈতিক অঞ্চলসমূহ (Diplomatic Zones)
- পর্যটন উন্নয়ন প্রকল্প (যেমন নিওম, সিনদালাহ আইল্যান্ড, রেড সি প্রজেক্ট)
এইসব স্থানে অ্যালকোহল বিক্রি হবে শুধুমাত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত বিক্রেতাদের মাধ্যমে এবং কেবল নির্ধারিত ক্রেতাদের জন্য। অনুমতি থাকবে বিদেশি পর্যটক, কূটনৈতিক মিশনের সদস্য, এবং কিছু নির্ধারিত বাণিজ্যিক কার্যক্রমের অংশগ্রহণকারীদের জন্য।
ভিশন ২০৩০ এবং বৈশ্বিক ইভেন্টের প্রস্তুতি
সৌদি সরকারের এ পদক্ষেপের পেছনে রয়েছে দেশটির উচ্চাকাঙ্ক্ষী উন্নয়ন পরিকল্পনা ‘ভিশন ২০৩০’। এই পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য হলো তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে এসে বিকল্প খাতে প্রবেশ করা, যার মধ্যে পর্যটন অন্যতম।
বিশ্বের নজর কাড়তে এবং বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্যে সৌদি আরব ২০৩০ সালের ওয়ার্ল্ড এক্সপো এবং ২০৩৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই ইভেন্টগুলোতে লক্ষ লক্ষ আন্তর্জাতিক দর্শনার্থীর আগমন প্রত্যাশিত, যাদের অনেকেই বিভিন্ন সংস্কৃতির অনুসারী এবং পশ্চিমা মূল্যবোধে অভ্যস্ত।
এ প্রেক্ষাপটেই সরকার এই কঠোর নিষেধাজ্ঞার কিছুটা শিথিলতা আনছে, যেন বিদেশি অতিথিরা তাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে কিছুটা স্বাধীনতা পান, তবে তা সীমিত পরিসরে এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণের আওতায়।
কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও লাইসেন্সিং ব্যবস্থা
সরকার নিশ্চিত করেছে যে, অ্যালকোহলের অনুমোদন কোনওভাবেই মুক্তবাজারভিত্তিক হবে না। বরং এটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত লাইসেন্সিং ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হবে। অনুমতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা এবং পরিচালনা নীতিমালা মেনে চলতে হবে।
এছাড়া অ্যালকোহল বিক্রির ক্ষেত্রে ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন, কোয়ান্টিটি কন্ট্রোল এবং নির্ধারিত সময়সীমা মেনে চলার নির্দেশনা থাকবে। কোনো নাগরিক বা প্রবাসী যদি এই নিয়ম লঙ্ঘন করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া
এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে সৌদি আরবের অভ্যন্তরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। একদিকে উদারপন্থীরা একে সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে প্রশংসা করছেন, অন্যদিকে রক্ষণশীল ধর্মীয় গোষ্ঠী এটিকে দেশের ইসলামী মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবে দেখছেন।
তবে সরকার স্পষ্ট করে জানিয়েছে, অ্যালকোহলের অনুমতি শুধুমাত্র নির্ধারিত জায়গায় এবং নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্যই সীমাবদ্ধ থাকবে। জনসাধারণের জন্য এটি এখনো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সম্ভাবনা
বিশ্বব্যাপী এই পদক্ষেপকে ‘প্রগতিশীল এবং কৌশলগত’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এবং আন্তর্জাতিক ইভেন্ট আয়োজকরা মনে করছেন, এটি সৌদি আরবকে একটি ‘ওপেন’ এবং ‘ক্লাব-ফ্রেন্ডলি’ দেশ হিসেবে তুলে ধরবে।
বিশ্লেষকদের মতে, যদিও এই সিদ্ধান্ত ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে, তবে এটি সৌদি সরকারের বাস্তববাদী ও আধুনিকীকরণমুখী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ।
উপসংহার
সৌদি আরবের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে দেশটি আন্তর্জাতিক বিশ্বে নিজের অবস্থান নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চায়। ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়নের পথে এটি এক সাহসী ও কৌশলগত পদক্ষেপ, যেখানে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এক ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তবে সফল বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে, যাতে করে এই নীতিগত পরিবর্তন সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি না করে বরং উন্নয়নের সহায়ক হয়।