কিয়েভে ব্যাপক হামলা, বন্দিবিনিময়ের পর শান্তিচুক্তির খসড়া পাঠাবে মস্কো

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তীব্রতায় ফের নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। শুক্রবার রাতে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে রাশিয়া যে ভয়াবহ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, তা তিন বছরের চলমান যুদ্ধে অন্যতম বড় আক্রমণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ইউক্রেন জানিয়েছে, ওই হামলায় রাজধানীর অন্তত ছয়টি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বহু ভবনে আগুন লাগে। একইসঙ্গে বন্দিবিনিময়ের পরিপ্রেক্ষিতে মস্কো শান্তিচুক্তির একটি খসড়া হস্তান্তরের প্রস্তুতির কথাও জানিয়েছে।
ব্যাপক ড্রোন হামলা: কিয়েভে আতঙ্ক
শুক্রবার রাতভর কিয়েভ শহরে একের পর এক বিস্ফোরণের শব্দে ভীত হয়ে পড়ে শহরের সাধারণ মানুষ। শহরের আকাশে ২৫০টি ড্রোন এবং ১৪টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে বলে দাবি করেছে ইউক্রেনীয় বিমানবাহিনী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ড্রোনগুলো শহরের আকাশে চক্কর দিতে থাকে এবং হঠাৎ করেই একাধিক বিস্ফোরণ ঘটে।
এই হামলায় কিয়েভের একটি বহুতল ভবনে আগুন ধরে যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে দ্রুত এগিয়ে আসে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। শহরের ছয়টি এলাকায় ড্রোনের আঘাতে ১৫ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে দুজন শিশু রয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ রাতকে ‘কঠিন রাত’ বলে উল্লেখ করেন এবং রাশিয়ার ওপর আরও কঠোর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার দাবি জানান।
পাল্টাপাল্টি হামলা ও প্রতিশোধের হুমকি
হামলার আগে ইউক্রেন গত কয়েক দিনে মস্কোসহ রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৪০০টি ড্রোন হামলা চালিয়েছিল। এই পটভূমিতেই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ঘোষণা দেন, ইউক্রেনের ওই হামলার জবাব দেবে মস্কো—এবং শুক্রবার রাতের হামলাকে সেই জবাব হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
এরইমধ্যে রাশিয়া দাবি করেছে, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের আরও তিনটি এলাকা—স্তুপোচকি, ওতরাদনে ও লোকনিয়া—তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। যদিও রয়টার্স এই দাবি স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি।
দ্বিতীয় দিনের বন্দিবিনিময়: সম্ভাব্য শান্তির ইঙ্গিত?
বড় ধরনের হামলার মধ্যে শনিবার দ্বিতীয় দিনের মতো বন্দিবিনিময় করেছে রাশিয়া ও ইউক্রেন। উভয় দেশ ৩০৭ জন করে বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে বলে জানিয়েছে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এর আগের দিন শুক্রবার ৫০ জন করে বন্দি মুক্তি পেয়েছিল। সম্প্রতি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উভয় দেশের প্রতিনিধিরা বন্দিবিনিময় সংক্রান্ত একটি চুক্তিতে উপনীত হন, যার আওতায় এক হাজার করে বন্দি মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এই বন্দিবিনিময়ের মাধ্যমে উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থার কিছুটা পুনর্গঠন হয়েছে বলে ধারণা করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। এ অবস্থায় মস্কোর পক্ষ থেকে শান্তিচুক্তির খসড়া হস্তান্তরের ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
শান্তিচুক্তির খসড়া প্রস্তুত করছে মস্কো
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভ জানান, বন্দিবিনিময় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর ইউক্রেনের হাতে একটি খসড়া শান্তিচুক্তি তুলে দেওয়া হবে। এই খসড়ায় যুদ্ধ বন্ধের জন্য রাশিয়ার পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত শর্তগুলো উল্লেখ থাকবে। লাভরভ বলেন, “শান্তি আলোচনার জন্য মস্কো সব সময় প্রস্তুত আছে। আমরা দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে বিশ্বাসী।”
ট্রাম্পের সক্রিয় ভূমিকা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। এ বিষয়ে তিনি একাধিকবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। সম্প্রতি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও ফোনালাপ করেন ট্রাম্প। ওই ফোনালাপের পর পুতিনও জানান, মস্কো যুদ্ধ বন্ধের জন্য আলোচনায় বসতে প্রস্তুত।
বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে এসব পদক্ষেপ ইউক্রেন সংকট সমাধানের একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে।
যুদ্ধের তিন বছর: চিত্রপট ও বর্তমান অবস্থা
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর মাধ্যমে যুদ্ধের সূচনা হয়। তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও যুদ্ধ এখনো পূর্ণ মাত্রায় চলছে। বর্তমানে ইউক্রেনের মোট ভূখণ্ডের প্রায় এক পঞ্চমাংশ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই যুদ্ধ ইউরোপজুড়ে জ্বালানি সংকট, অর্থনৈতিক চাপ এবং বিপুল সংখ্যক মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার মতো সংকট সৃষ্টি করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে বড় পরিসরের বন্দিবিনিময় এবং শান্তিচুক্তির খসড়া আলোচনার প্রসঙ্গ নিয়ে আসা যুদ্ধ শেষ করার সম্ভাব্য একটি দিক বলে মনে করছেন কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তবে শান্তিচুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ইউক্রেনের প্রতিক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক চাপ কতটা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যায় তার ওপর।
উপসংহার
কিয়েভে রাশিয়ার সাম্প্রতিক ভয়াবহ ড্রোন হামলা আবারও মনে করিয়ে দেয়, যুদ্ধ এখনো কতটা বিস্ফোরক ও অনির্দেশ্য রয়ে গেছে। তবে এরইমধ্যে বন্দিবিনিময় এবং শান্তিচুক্তির খসড়া হস্তান্তরের ঘোষণাকে ভবিষ্যতের শান্তির সম্ভাব্য ভিত্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। এখন বিশ্ববাসীর নজর থাকবে ইউক্রেনের প্রতিক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যস্থতামূলক ভূমিকার দিকে।