বিশ্ব

‘নিষ্ঠুরতম পর্যায়ে’ প্রবেশ করছে গাজা সংঘাত: জাতিসংঘের মহাসচিব

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নিরবচ্ছিন্ন হামলা ও ত্রাণ সরবরাহে চরম সংকটের কারণে মানবিক বিপর্যয় এক ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই সংঘাতকে ‘নিষ্ঠুরতম পর্যায়ে’ প্রবেশের পথে বলে বর্ণনা করেছেন। ত্রাণের অভাবে গাজার বাসিন্দারা দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। মধ্য গাজার নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে খাবারের জন্য অপেক্ষারত এক শিশুর কান্নার দৃশ্য এই সংকটের তীব্রতা প্রকাশ করে। ইসরায়েলের অব্যাহত হামলা ও ত্রাণ সরবরাহে বিধিনিষেধের কারণে গাজার জনগণ চরম দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

সংঘাতের তীব্রতা ও মানবিক বিপর্যয়

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েল গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে আসছে। সম্প্রতি ‘অপারেশন গিডেয়নস চ্যারিয়টস’ নামে একটি নতুন সামরিক অভিযান শুরু করার পর এই হামলার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ মাসে ইসরায়েলের হামলায় ৫৩,৯০১ জন নিহত এবং ১,২২,৫৯৩ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া, গাজার জনসংযোগ কার্যালয়ের হিসাবে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণকারীদের সংখ্যা বিবেচনায় মোট নিহতের সংখ্যা ৬১,৭০০-এ পৌঁছেছে। এই পরিসংখ্যান গাজার মানবিক বিপর্যয়ের ভয়াবহতা তুলে ধরে।

জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বলেন, “গাজায় প্রাণ বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি প্রায় ৮০ দিন ধরে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে গাজার বাসিন্দারা দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়েছেন।” তিনি গাজায় ত্রাণ সরবরাহের জন্য ‘বন্যার মতো’ বিপুল পরিমাণ সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। তবে, ইসরায়েলের দেওয়া সীমিত ত্রাণের অনুমতিকে তিনি ‘এক চামচ পানি’র সাথে তুলনা করেন, যা গাজার বিশাল চাহিদার তুলনায় নগণ্য।

ত্রাণ সংকটের ভয়াবহতা

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজায় প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০০ ট্রাক ত্রাণ সরবরাহের প্রয়োজন। কিন্তু ইসরায়েলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত সোমবার থেকে কারেম আবু সালেম ক্রসিং দিয়ে মাত্র ৩০০ ট্রাক ত্রাণ গাজায় প্রবেশ করেছে। জাতিসংঘের অভিযোগ, নিরাপত্তা ঝুঁকি ও বিশৃঙ্খলার কারণে এই ত্রাণের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ গাজার বিভিন্ন গুদামে পৌঁছাতে পেরেছে। ফলে, ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে খাবার ও পানির জন্য মানুষের দীর্ঘ সারি দেখা যাচ্ছে। অনেক ত্রাণ কেন্দ্র ও দাতব্য রান্নাঘর বন্ধ হয়ে গেছে, যা গাজার মানবিক সংকটকে আরও গভীর করেছে।

আল-জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ গাজা থেকে জানান, “গত দুই দিনে গাজায় যে পরিমাণ খাবার পৌঁছেছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। এই পরিমাণ ত্রাণ গাজার মানবিক সংকটের সমাধানে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না।” ত্রাণের অভাবে শিশু ও নারীসহ গাজার সাধারণ মানুষ চরম কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়া এক শিশুর ছবি এই সংকটের মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরে।

ইসরায়েলের সামরিক কৌশল ও বাসিন্দাদের উচ্ছেদ

ইসরায়েল গাজার ৮০ শতাংশ এলাকাকে সামরিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং সেখানকার বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এই নির্দেশের ফলে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়ে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। তবে, এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও পর্যাপ্ত খাবার, পানি বা চিকিৎসা সুবিধা নেই। জাতিসংঘের মহাসচিব সতর্ক করে বলেন, দ্রুত এবং দীর্ঘমেয়াদি ত্রাণ সরবরাহ না করা হলে গাজায় মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়বে।

ইসরায়েলের এই সামরিক অভিযান ও ত্রাণ সরবরাহে বিধিনিষেধ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। গুতেরেস বলেন, “গাজার বাসিন্দাদের দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এটি কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘনই নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানবিক আইনেরও লঙ্ঘন।” তিনি অবিলম্বে ত্রাণ সরবরাহের পথ উন্মুক্ত করার এবং সংঘাত বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও চাপ

ইসরায়েলের এই হামলা ও ত্রাণ সরবরাহে বিধিনিষেধের কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্বিবেচনা করছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় নৃশংসতার পর ইউরোপ কি ইসরায়েলকে পরিত্যাগ করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া, জেরুজালেমে ৫০০ বছরের পুরোনো একটি মাজার দখল করে তা বাড়িতে রূপান্তরের ঘটনাও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।

গাজার সংঘাত শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্যই নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি মানবিক পরীক্ষা। শিশুদের কান্না, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া মানুষের আর্তনাদ, এবং ত্রাণের জন্য দীর্ঘ সারি এই সংকটের গভীরতা প্রকাশ করে। জাতিসংঘের মহাসচিবের আহ্বান, “এই নৃশংসতা বন্ধ করতে হবে। গাজার মানুষের জন্য ত্রাণের পথ উন্মুক্ত করতে হবে।”

উপসংহার

গাজার বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্বের বিবেকের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। ইসরায়েলের অব্যাহত হামলা ও ত্রাণ সরবরাহে বিধিনিষেধের কারণে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বারবার আহ্বান জানানো হলেও, পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। গাজার শিশু ও সাধারণ মানুষের কষ্ট কমাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। এই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এবং মানবিক দায়বদ্ধতা অপরিহার্য।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button