ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তূপে ফিরছে ফিলিস্তিনিরা, প্রাণ হারিয়েছেন ৫৩ হাজারের বেশি

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের ১৯ মাস পেরিয়ে গেলেও মধ্যপ্রাচ্যের এই সংকটপূর্ণ অঞ্চলে সহিংসতা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ইসরায়েলের লাগাতার বিমান ও স্থল অভিযানে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরজুড়ে অসংখ্য নিরীহ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে গাজার উত্তরাঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি এখনো নিজেদের বাড়ি ফিরে যেতে চাইলেও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না।
ধ্বংসস্তূপে ফেরার চেষ্টা
সম্প্রতি গাজার সিটি এলাকায় ইসরায়েলি বিমান হামলার পর কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা একটি ছবি প্রকাশ করে যেখানে দেখা যায়, এক ফিলিস্তিনি নারী ধোঁয়া ও ধুলার মাঝ দিয়ে রাস্তা খুঁজে ফিরছেন। এ দৃশ্য যেন গোটা গাজা উপত্যকার পরিস্থিতিকে প্রতীকী ভাষায় তুলে ধরেছে। চারদিকে ধ্বংসাবশেষ, বাতাসে বারুদের গন্ধ আর অনিশ্চয়তা—এ যেন এক চলমান মানবিক বিপর্যয়।
প্রাণহানির মর্মান্তিক পরিসংখ্যান
আল জাজিরা জানায়, গাজায় চলমান ইসরায়েলি অভিযানে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৫৩ হাজার ৮২২ জন ফিলিস্তিনি। যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার সতর্ক করলেও হামলার মাত্রা কমেনি, বরং দিনদিন বেড়েই চলেছে।
অধিকৃত পশ্চিম তীরেও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। জাতিসংঘের হিসাবে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পশ্চিম তীরে নিহত হয়েছেন ৯৩৮ জন ফিলিস্তিনি, যাদের মধ্যে অন্তত ১৯৮ জন শিশু। নিহতদের মধ্যে অনেকেই ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিতে এবং ইহুদি বসত স্থাপনকারীদের সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন।
২০২৫ সালেই নিহত ১৩২ জন
মাত্র ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসেই পশ্চিম তীরে নিহত হয়েছেন ১৩২ জন ফিলিস্তিনি, যাদের মধ্যে ২৫ জনেরও বেশি শিশু রয়েছে। প্রতিটি মৃত্যুই ফিলিস্তিনিদের জীবনে শোক আর ভয়ের নতুন অধ্যায় যোগ করছে। বাস্তুচ্যুতি, চরম দারিদ্র্য, চিকিৎসার অভাব—সব মিলিয়ে মানবিক পরিস্থিতি শোচনীয়।
ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি: ঘর ফেরা অনিশ্চিত
শুধু হত্যাকাণ্ড নয়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অভিযান ফিলিস্তিনি জনগণকে বাস্তুচ্যুত করতেও বাধ্য করছে। গত জানুয়ারিতে পশ্চিম তীরের নূর শামস, তুলকারেম ও জেনিন শরণার্থী শিবিরে চালানো ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে প্রায় ৪২ হাজার মানুষ ঘরছাড়া হন। আল জাজিরার তথ্যমতে, তাদের অনেকে আজও নিজেদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারেননি।
জীবনযাত্রা ভয়াবহভাবে ব্যাহত
গাজার পাশাপাশি পশ্চিম তীরেও ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ও সামরিক উপস্থিতি ফিলিস্তিনিদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলছে। চিকিৎসাসেবা, খাদ্য, শিক্ষা, পানি ও বিদ্যুতের মতো মৌলিক সেবা পেতে হিমশিম খাচ্ছে স্থানীয় জনগণ। স্বাস্থ্য খাতে সংকট এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে, একাধিক হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ নেই, এবং শিশুদের চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু ঘটছে।
আন্তর্জাতিক নীরবতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার বলছে, ইসরায়েলের এই কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও যুদ্ধ আইনের চরম লঙ্ঘন। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। জাতিসংঘে কয়েকবার প্রস্তাব উঠলেও ভেটোর কারণে অনেক সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়নি।
পেছনের প্রেক্ষাপট
২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া এই যুদ্ধের পেছনে রয়েছে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব, ফিলিস্তিনিদের জমি ও অধিকার হরণ এবং দমননীতি। হামাসের পাল্টা হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল যে আক্রমণ শুরু করে, তা সীমা ছাড়িয়ে এখন জনসাধারণের ওপর ভয়াবহ নিপীড়নে পরিণত হয়েছে।
প্রতিদিন বাড়ছে শঙ্কা
একাধিক বিশ্লেষকের মতে, যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুত হস্তক্ষেপ না করে, তবে এই সংকট আরো ঘনীভূত হবে। বাস্তুচ্যুতদের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং গাজার পুরো অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বর্তমানে গাজার বেশিরভাগ হাসপাতাল, স্কুল ও বাসস্থান সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত।
ইসরায়েল-হামাস সংঘাত বর্তমানে কেবল একটি রাজনৈতিক বিরোধ নয়, এটি এক ভয়াবহ মানবিক সংকটে রূপ নিয়েছে। প্রতিদিন ধ্বংসস্তূপে ফেরা মানুষের চোখে অশ্রু, মুখে আতঙ্ক আর অন্তরে নিঃসঙ্গতা প্রতিফলিত হচ্ছে। যুদ্ধ থামাতে হলে শুধু অস্ত্র নয়, দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আন্তর্জাতিক চাপ ও মানবিক মূল্যবোধের জয়।