সিরিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিথিল: সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পথে বড় পদক্ষেপ

যুক্তরাষ্ট্র অবশেষে সিরিয়ার উপর দীর্ঘদিন ধরে জারি থাকা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের জারি করা সাম্প্রতিক এক নির্বাহী আদেশে এই পরিবর্তনের ঘোষণা আসে। ট্রাম্প প্রশাসনের মতে, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় মানবিক সহায়তা, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও নতুন রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পথ উন্মুক্ত হবে।
এক দশকের পুরনো নিষেধাজ্ঞার অবসান
২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। স্বৈরশাসক আসাদকে লক্ষ্য করে নেওয়া এই পদক্ষেপের অংশ হিসেবে সিরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও শীর্ষ ব্যক্তিদের ওপর অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়।
তবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এক নাটকীয় পরিবর্তনে, বিদ্রোহীদের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয় সিরিয়ায়। আহমেদ আল-শারা নামক এক প্রাক্তন কূটনীতিক ও বিদ্রোহী নেতা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। শারা সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পরই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সিরিয়ার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে।
নতুন অধ্যায়ের শুরু: জিএল২৫ লাইসেন্স অনুমোদন
মার্কিন অর্থ বিভাগ “জেনারেল লাইসেন্স ২৫” (GL25) নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুমতিপত্র ইস্যু করেছে। এই লাইসেন্সের অধীনে সিরিয়ার সঙ্গে পূর্বে নিষিদ্ধ হওয়া লেনদেন এখন বৈধ বলে গণ্য হবে। এর ফলে:
- সিরিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবার আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন করতে পারবে।
- রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম শুরু করতে পারবে।
- সিরিয়ার ভেতরে ও বাইরে থেকে বেসরকারি বিনিয়োগ সহজতর হবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশলগত পরিবর্তন
ট্রাম্প প্রশাসনের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই সিদ্ধান্ত “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এটি সিরিয়ায় মার্কিন বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক স্বার্থকে জোরদার করবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেও সম্প্রতি সৌদি আরব সফরে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে দুই দেশের মধ্যে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা ইস্যুতে আলোচনা হয়।
ট্রাম্পের মন্তব্য ছিল, “আমরা সিরিয়ার জনগণকে সহায়তা করতে চাই, তবে আমরা তাদের সরকারের কাছ থেকেও দায়িত্বশীল আচরণ আশা করি।”
মানবিক সহায়তার জন্য ১৮০ দিনের ছাড়পত্র
সিরিয়ার অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত পুনর্গঠনে সহায়তার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও “সিজার আইন”-এর আওতায় একটি ১৮০ দিনের ছাড়পত্র ইস্যু করেছেন। এর আওতায়:
- বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি ও স্যানিটেশন খাতে বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি থাকবে।
- মানবিক সংস্থা ও এনজিওগুলো সহজে খাদ্য, ওষুধ ও সাহায্য সামগ্রী পাঠাতে পারবে।
- সিরিয়ার জনগণের জীবনযাত্রা সহজ করতে আন্তর্জাতিক সহায়তা ত্বরান্বিত হবে।
রুবিও এক বিবৃতিতে বলেন, “এই পদক্ষেপ সিরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি নতুন, গঠনমূলক সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তুলবে।”
সিরিয়ার প্রতিক্রিয়া: ইতিবাচক আশাবাদ
শনিবার সকালে সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, “এটি একটি মানবিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। যুদ্ধের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের জন্য এটি একটি আশার আলো।”
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাশা
যদিও নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়েছে, সিরিয়ার সরকারকে এখনো কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে:
- যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা।
- মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন।
- অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলেও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা এখনো দ্বিধায় আছেন। অনেকেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখছেন—বিশেষত সিরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে।
আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব
এই নিষেধাজ্ঞা শিথিলের সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থানেও পরিবর্তন আনবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে, রাশিয়া ও ইরান—যারা সিরিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ছিল—তাদের প্রতিক্রিয়া এখনো পরিষ্কার নয়।
তবে আরব লীগের কয়েকটি সদস্য দেশ ইতিমধ্যেই সিরিয়ার নতুন সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। সউদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন এই পদক্ষেপকে “সময়োপযোগী ও বাস্তববাদী” বলে অভিহিত করেছে।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ও পরিবর্তন
- ২০১১: আরব বসন্তের ছোঁয়ায় সিরিয়ায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়।
- ২০১2-2019: গৃহযুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু, লাখো শরণার্থী।
- ২০১৪: আইএস উত্থান এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ।
- ২০২০-২০২৩: সিরিয়া আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন; অর্থনৈতিক সংকট চরমে।
- ডিসেম্বর ২০২৪: আহমেদ আল-শারার নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা বাশার আল-আসাদকে উৎখাত করে।
পরিবর্তনের পথে সিরিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা শিথিলের সিদ্ধান্ত সিরিয়ার জন্য শুধু অর্থনৈতিক মুক্তির বার্তা নয়, বরং আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি নতুন পরিচয় গঠনের সম্ভাবনাও তৈরি করছে। এখন দেখার বিষয়, এই কূটনৈতিক অগ্রগতি বাস্তবে কতটা টেকসই হয় এবং তা কত দ্রুত সিরিয়ার সাধারণ মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।