পানিসংকটে চরম দুর্দশায় গাজাবাসী, লবণাক্ত পানি পান করছে শিশুরা

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি অবরোধ ও ধারাবাহিক হামলার ফলে ভয়াবহ মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সেই সংকটের সবচেয়ে জ্বলন্ত উদাহরণ বর্তমানে পানির তীব্র অভাব। জাতিসংঘ সতর্ক করেছে—জ্বালানি সরবরাহ না হলে কয়েকদিনের মধ্যে পুরো গাজা উপত্যকায় পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে গাজার শিশুদের লবণাক্ত পানি পান করানো হচ্ছে, যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে।
নিরাপদ পানির অভাবে কষ্টে ফিলিস্তিনিরা
গত ১৯ মাস ধরে গাজা উপত্যকায় চলমান ইসরায়েলি হামলা ও অবরোধের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। ইউনিসেফের তথ্যমতে, গাজার পানি শোধনাগারগুলো এখন বিদ্যুতের অভাবে প্রায় অচল। দক্ষিণ গাজার একটি শোধনাগার সম্প্রতি পরিদর্শন করেন সংস্থাটির কর্মকর্তা জোনাথন ক্রিকস। তিনি বলেন, “বিদ্যুৎ না থাকায় পানি উৎপাদন ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে পুরো অঞ্চলে পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে।”
গাজার বাসিন্দা রায়েদ আল–জাহারনেহ বলেন, “আমরা আমাদের সন্তানদের লবণাক্ত পানি খাওয়াচ্ছি। এতে তাদের পেটব্যথা, ডায়রিয়া এমনকি কিডনি সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের কিছুই করার নেই। বিশুদ্ধ পানি পাওয়াই অসম্ভব হয়ে উঠেছে।”
ত্রাণ প্রবেশে সীমাবদ্ধতা, জ্বালানি এখনো নিষিদ্ধ
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপের মুখে ইসরায়েল সম্প্রতি গাজায় সীমিত ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দিলেও জ্বালানি সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে। বুধবার জাতিসংঘ জানায়, তারা মাত্র ৯০টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করাতে পেরেছে। যদিও সেখানে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০০ ট্রাক ত্রাণ প্রয়োজন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রমবিষয়ক সমন্বয় দপ্তর (ওসিএইচএ)।
ওসিএইচএর মুখপাত্র জেনস লার্ক জানান, “ত্রাণের মধ্যে ছিল ময়দা, পুষ্টিকর খাবার এবং কিছু চিকিৎসা সামগ্রী। তবে এই ত্রাণ যথেষ্ট নয়। নিরাপত্তাহীনতা, লুটপাটের ঝুঁকি এবং ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয়ের অভাবের কারণে কাজটি অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
জ্বালানির অভাবে বন্ধ হওয়ার মুখে পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা
জ্বালানি সরবরাহ না থাকায় সবচেয়ে বড় সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থায়। উত্তর গাজায় ইতোমধ্যে জ্বালানির মজুত শেষ হয়ে গেছে। ফলে সেখানকার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে এবং পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে ডায়রিয়া, কলেরা ও পানিবাহিত অন্যান্য রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এটি মারাত্মক বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে।
মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে চলছে অব্যাহত হামলা
পানিসংকট ও ত্রাণসঙ্কটের পাশাপাশি গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি ইসরায়েল ‘অপারেশন গিডেয়নস চ্যারিয়টস’ নামে নতুন সামরিক অভিযান শুরু করেছে, যার আওতায় হামলার মাত্রা আরও বেড়েছে। বৃহস্পতিবারের হামলায় নিহত হয়েছেন ৫১ জন, যা নিয়ে ১৯ মাসে মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৬৫৫ জনে।
উত্তর গাজার একাধিক এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনী বাসিন্দাদের সরে যেতে বলেছে। গতকাল শুধু একদিনেই ১৪টি এলাকা থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এদিকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, হামাস নেতা মোহাম্মদ সিনওয়ারকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি হামাসের সাবেক প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারের ভাই।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক চাপ
গাজায় চলমান সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও জোরালো হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান কাজা কালাস বলেছেন, “জেনিনে বিদেশি কূটনীতিকদের দিকে সতর্কতামূলক গুলি চালানো হয়েছে—এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এর সঙ্গে জড়িতদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।”
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসরায়েলের এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, “আমরা গাজায় দ্রুত মানবিক সাফল্য দেখতে পাব। আশা করি, যুদ্ধের অবসান হবে এবং সব জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে।”
মানবতার বিপর্যয়ে করণীয় কী?
গাজায় বর্তমান সংকট মানবতার জন্য একটি জ্বলন্ত প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানির মতো মৌলিক অধিকার থেকেও ফিলিস্তিনিদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ, জ্বালানি এবং চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা উচিত।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শুধু ত্রাণ পাঠিয়েই গাজার সংকট নিরসন সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অবরোধ প্রত্যাহার, এবং টেকসই শান্তিচুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান। না হলে আগামী দিনে গাজার মানবিক বিপর্যয় আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।