বিশ্ব

গাজায় এখনো পৌঁছেনি ত্রাণ: সীমিত অনুমতির এক দিন পরও

একদিকে গাজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা, অন্যদিকে সীমিত ত্রাণ অনুমতির এক দিন পার হলেও বাস্তবে ত্রাণ বিতরণের কোনো অগ্রগতি নেই। ইসরায়েল সীমান্ত দিয়ে গাজায় ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দিলেও ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে—জাতিসংঘ বলছে, এখনো কোনো ত্রাণসামগ্রী বাস্তবভাবে বিতরণ শুরু হয়নি।

ইসরায়েলের ‘সীমিত অনুমতি’ আর বাস্তবতা

গত সোমবার (২০ মে) ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, তারা গাজা উপত্যকায় সীমিত পরিমাণে ত্রাণ পাঠানোর অনুমতি দিয়েছে। তবে মঙ্গলবার (২১ মে) জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের এখনো ত্রাণ বিতরণ শুরু করা সম্ভব হয়নি। অনুমতির ঘোষণার পরও বাস্তবে কোনো প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।’

তিনি আরও জানান, ইসরায়েল কেবল কেরেম শালোম সীমান্তে ত্রাণসামগ্রী নামিয়ে রাখতে বলেছে, কিন্তু গাজার ভেতরে ঢুকে সেগুলো সংগ্রহ ও বিতরণের জন্য জাতিসংঘের দল এখনো ইসরায়েলি অনুমতির অপেক্ষায় আছে।

কেরেম শালোমে অপেক্ষা, কিন্তু অনুমতি নেই

ডুজারিকের ভাষায়, ‘আজ আমাদের একটি দল কেরেম শালোম এলাকায় প্রবেশ করে পুষ্টিসামগ্রী সংগ্রহের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করেছে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও তারা অনুমতি পায়নি। ফলে ত্রাণসামগ্রী আমাদের গুদামে নেওয়া সম্ভব হয়নি।’

জাতিসংঘের উদ্বেগ: এক ফোঁটা পানি সমতুল্য সাহায্য

জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিভাগের প্রধান টম ফ্লেচার বলেছেন, ‘ইসরায়েলের অনুমতিপ্রাপ্ত ত্রাণের পরিমাণ এতই কম যে তা সমুদ্রে এক ফোঁটা পানির মতো।’ তিনি আরও জানান, গাজায় মানবিক বিপর্যয় এমন জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে দ্রুত, অবাধ ও নিরবিচারে ত্রাণ সরবরাহ না হলে হাজারো প্রাণ ঝরে পড়তে পারে, বিশেষ করে শিশুরা চরম ঝুঁকিতে।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজায় ১৪ হাজার শিশু অনাহারের কারণে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে, যদি দ্রুত ত্রাণ না পৌঁছে।

অবরোধে বিধ্বস্ত গাজা, দ্বারপ্রান্তে দুর্ভিক্ষ

গত ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত অবরোধ, বিমান হামলা ও স্থল অভিযানে পুরো গাজা কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রায় ৮ মাস ধরে চলা সংঘাতে শিক্ষা, চিকিৎসা ও খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) ও অন্যান্য সংস্থা সতর্ক করেছে, গাজার উত্তরাঞ্চলে ইতোমধ্যেই দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে, আর বাকি অঞ্চলেও তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

ইসরায়েলের অবস্থান: ‘ত্রাণের অপব্যবহার রোধ’

ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা ত্রাণ প্রবেশে বাধা দিচ্ছে কারণ এসব পণ্য হামাসের হাতে পড়ে যেতে পারে, যারা তা অস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। তবে হামাস এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এ ধরনের অজুহাতে নিরীহ জনগণকে বঞ্চিত করা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন

যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত নতুন ত্রাণ পরিকল্পনায় জাতিসংঘের অংশ না হওয়ার ঘোষণা

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত একটি দল গাজায় ত্রাণ বিতরণের নতুন ‘মডেল’ চালু করার ঘোষণা দিয়েছে। মে মাসের শেষ নাগাদ দলটি মাঠে নামবে বলে জানানো হয়েছে। তবে জাতিসংঘ বলছে, এই মডেল নিরপেক্ষ বা পক্ষপাতহীন নয়, তাই তারা এতে অংশ নেবে না।

জাতিসংঘের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ত্রাণ বিতরণে পক্ষপাতিত্ব বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অনুপ্রবেশ করলে সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব নয়।’

ত্রাণবাহী শতাধিক ট্রাক অপেক্ষায়

জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র বলেন, বর্তমানে ১০০টির বেশি ত্রাণবাহী ট্রাক ইসরায়েলি সীমান্তে অপেক্ষা করছে। কেরেম শালোম সীমান্তে ট্রাকগুলো আটকে আছে, কারণ ইসরায়েলি বাহিনীর কাছ থেকে ‘সবুজ সংকেত’ এখনো আসেনি। ত্রাণবাহী লরিগুলোর ছবি ইতোমধ্যেই বিশ্ব গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

ইসরায়েলের যুদ্ধ পরিকল্পনা অব্যাহত

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সোমবার জানান, ‘আমরা গাজার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেব।’ তিনি বলেন, হামাসকে নির্মূল করা ছাড়া ইসরায়েলের আর কোনো উপায় নেই। এরই অংশ হিসেবে তারা রাফাহ শহরে অভিযান শুরু করেছে, যেখানে ১০ লাখের বেশি গাজাবাসী আগে থেকেই আশ্রয় নিয়েছিল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল ত্রাণ সরবরাহকে একটি রাজনৈতিক চাপ হিসেবে ব্যবহার করছে, যেন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমালোচনার ভারসাম্য রক্ষা করা যায়।

সংক্ষিপ্ত তথ্যে গাজা সংকট

  • ১১ সপ্তাহ ধরে গাজা কার্যত অবরুদ্ধ।
  • সোমবার ৪টি ট্রাকে শিশুখাদ্য গাজার ফটকে পৌঁছালেও বিতরণ হয়নি।
  • মঙ্গলবার আরও কিছু ট্রাক ঢুকলেও গুদামে পাঠানো যায়নি।
  • ১৪ হাজার শিশু মৃত্যুঝুঁকিতে।
  • ১০০+ ট্রাক এখনো সীমান্তে আটকে।
  • জাতিসংঘের ত্রাণ কর্মকর্তা বলছেন, ত্রাণ মাত্রা “সমুদ্রে একফোঁটা”।

গাজার মানবিক সংকট এখন আর কেবল একটি যুদ্ধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নয়—এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি নজিরবিহীন মানবাধিকার বিপর্যয়। ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে কাগজে, কিন্তু বাস্তবে শিশুদের মুখে খাবার পৌঁছায়নি। ইসরায়েলের এই “সীমিত অনুমতি” কতটা কার্যকর, তা সময় বলে দেবে—তবে সময়ই তো এখন সবচেয়ে বড় সংকট।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button