ফ্যাক্ট চেক

কিসাস কী, এর বিধান নিয়ে কোরআনে যা বলা হয়েছে

Advertisement

মানবজীবনের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। তবে শুধু রাষ্ট্রীয় আইন নয়, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এই নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা, যেখানে অপরাধের প্রতিকার ও প্রতিরোধে রয়েছে সুস্পষ্ট নীতিমালা। এর মধ্যে অন্যতম হলো “কিসাস”—একটি ন্যায়বিচারমূলক ও প্রতিশোধমূলক শাস্তির বিধান, যা অপরাধকে প্রতিহত করে এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে।

কিসাস শব্দের অর্থ ও মূল ধারণা


কিসাস” (القصاص) শব্দটি আরবি থেকে এসেছে। এর আভিধানিক অর্থ হলো সমান প্রতিশোধ, অর্থাৎ কোনো অপরাধের সমপরিমাণ শাস্তি প্রদান। উদাহরণস্বরূপ, ইচ্ছাকৃত হত্যার বদলে হত্যাকারীকেও হত্যা করা, যা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সুগম করে।

ব্যাকরণগত অর্থে কিসাসের অর্থ হয়, কারও কৃতকর্মের প্রত্যুত্তর দেওয়া এবং অপরাধীর প্রতি ঠিক সেই আচরণ করা, যা সে অন্যের প্রতি করেছে। এই বিধান শুধুমাত্র প্রতিশোধ নয়, বরং একটি সতর্কবার্তা—যাতে অন্যরা ওই অপরাধে লিপ্ত না হয়।

কোরআনের আলোকে কিসাসের গুরুত্ব
কোরআনে বিভিন্ন স্থানে কিসাসের বিধান সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে। সূরা বাকারা এবং সূরা মায়েদা-তে এ সংক্রান্ত আয়াত রয়েছে।

সূরা বাকারা, আয়াত ১৭৯

وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

অর্থ: “হে বুদ্ধিমানগণ! কিসাসের মাঝে তোমাদের জীবনের নিরাপত্তা রয়েছে; যাতে তোমরা সাবধান হও।”

এই আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায়, কিসাস সমাজে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

সূরা মায়েদা, আয়াত ৪৫

النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ…

অর্থ: “প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ… জখমের বদলে জখম—এভাবেই সমান প্রতিদান দেয়া হবে।”

এখানে প্রতিটি অঙ্গহানির জন্যও অনুরূপ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, যা সমাজে ভারসাম্য বজায় রাখে।

কিসাসের মাধ্যমে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা


ইসলামী আইনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিসাস এমন এক আইন, যেখানে কারও প্রতি পক্ষপাত করা হয় না।

  • ধনী-গরিব, শাসক-শাসিত—সবার জন্য আইন সমান।
  • হত্যা বা গুরুতর শারীরিক আঘাতের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি অপরাধ প্রমাণিত হয়, তবে তাকে শাস্তি পেতেই হবে।

তবে কোরআন কিসাসের পাশাপাশি ক্ষমাদিয়ত (আর্থিক ক্ষতিপূরণ)-এর কথাও বলেছে।

সূরা বাকারা, আয়াত ১৭৮

“…যদি নিহতের ওলি (উত্তরাধিকারী) কিছুটা ক্ষমা করে, তাহলে ন্যায়পথে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে এবং সদ্ব্যবহার করতে হবে।”

এটি ইসলামের করুণাময় দিককে তুলে ধরে। একদিকে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, আবার অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার চাইলে দয়াপরবশ হয়ে মাফ করে দিতে পারে।

কিসাস ও দায়িত্ববোধ: কে কার্যকর করবে এই শাস্তি?


ইসলামী শরিয়তে কিসাস বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রের, ব্যক্তির নয়। অর্থাৎ কেউ নিজের হাতে কিসাসের রায় কার্যকর করতে পারবে না।

মূলনীতি:

  • অপরাধ প্রমাণিত হতে হবে নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য ও প্রমাণের মাধ্যমে।
  • আদালত বা বৈধ ইসলামিক বিচারব্যবস্থার মাধ্যমেই শাস্তি কার্যকর হবে।
  • নিহতের পরিবার যদি মাফ করে দেয় বা দিয়ত নেয়, তাও হবে বৈধভাবে ও প্রমাণসহ।

এই কাঠামো অপরাধের প্রতিকারের পাশাপাশি সমাজে শান্তি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক।

কিসাসের মাফ ও ইসলামে দয়াশীলতার দৃষ্টিভঙ্গি


ইসলাম প্রতিশোধের পাশাপাশি দয়া ও করুণারও ধর্ম। কিসাস মাফ করার অধিকার কেবল নিহতের ওয়ারিসদের।

  • তারা চাইলে পূর্ণ ক্ষমা,
  • অথবা আর্থিক ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করে দয়া প্রদর্শন করতে পারে।
  • তবে এই সিদ্ধান্তও গ্রহণযোগ্য হবে বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

এক আয়াতে বলা হয়েছে:

“যে ক্ষমা করবে, তার জন্য এটি গুনাহের কাফফারা হয়ে যাবে।” (সূরা মায়েদা: ৪৫)

আজকের প্রেক্ষাপটে কিসাসের প্রয়োজনীয়তা


বর্তমানে হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, অপরাধ দমন এবং ভুক্তভোগীদের অধিকার নিশ্চিত করতে কিসাসের মতো ইনসাফপূর্ণ বিধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অনেক সময় বিচারহীনতা সমাজে অপরাধকে উৎসাহিত করে। কিন্তু কিসাসের মতো কঠোর ও ন্যায়সঙ্গত আইন অপরাধীদের জন্য একটি সতর্কবার্তা।

কিসাস – জীবন রক্ষার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত


কিসাস শুধু প্রতিশোধ নয়, এটি হলো ন্যায়বিচারের প্রতীক এবং সমাজে অপরাধ দমনের হাতিয়ার। এতে যেমন অপরাধীর যথোপযুক্ত শাস্তি হয়, তেমনি ভবিষ্যতে অন্যদের জন্য সতর্কবার্তা হয়ে থাকে।

আল্লাহর বিধানে রয়েছে জীবন, নিরাপত্তা ও শান্তি। কোরআনের আলোকে আমরা যদি এই বিধান বুঝি ও বাস্তবায়ন করি, তাহলে সমাজ থেকে অনেক অশান্তি দূর হবে।

এম আর এম – ০২৯১, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button