বিশ্ব

খাবার প্রবেশে অনুমতি দিলেও গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চাইছে ইসরায়েল

১১ সপ্তাহের অবরোধের পর অবশেষে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় সীমিত আকারে খাদ্য প্রবেশে অনুমতি দিয়েছে ইসরায়েল। তবে এরই সঙ্গে ইসরায়েল স্পষ্ট করে জানিয়েছে, তারা গাজার পুরো ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে নিতে চায় এবং হামাস যেন আর কখনও সেখানে সংগঠিত হতে না পারে, সে লক্ষ্যেই তারা এগোচ্ছে।

গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান ইসরায়েল-হামাস সংঘাতের মধ্যে গাজা এক চরম মানবিক সংকটে পড়ে। অবরুদ্ধ এই উপত্যকায় খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ ছিল। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মহলের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে ইসরায়েল কেরেম শালোম ক্রসিং দিয়ে কিছু ট্রাক ত্রাণ প্রবেশে অনুমতি দেয়।

সীমিত সহায়তা, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ রাখার কৌশল?

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানায়, “গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানো নিশ্চিত করতে আমরা সীমিত পরিসরে খাদ্য প্রবেশের অনুমতি দিয়েছি, যাতে দুর্ভিক্ষ দেখা না দেয়।”

তবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সুপারিশের ভিত্তিতে। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এই মানবিক পদক্ষেপ মূলত সামরিক কৌশলের অংশ। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “সহায়তা যেন হামাসের হাতে না পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করতে ইসরায়েল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।”

এর মানে হচ্ছে, গাজায় খাদ্য ঢুকলেও তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে। মানবিক ত্রাণ যেন ‘সন্ত্রাসীদের হাতে’ না যায়—এই যুক্তিতে গাজাবাসীর মৌলিক চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রেও সেনা হস্তক্ষেপ অব্যাহত থাকবে।

সহায়তার আগে অভিযান: পরিকল্পিত দ্বৈত বার্তা?

এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগেই ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় নতুন করে বিস্তৃত সামরিক স্থল অভিযান শুরু করে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, এই অভিযানের মধ্যেই ত্রাণ প্রবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়, যাতে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ সাময়িকভাবে হ্রাস করা যায়।

এইভাবে সহানুভূতির আবরণে সামরিক অভিযান চালিয়ে যাওয়ার কৌশল ইসরায়েল পূর্বেও গ্রহণ করেছে বলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা অভিযোগ করেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না বলেই মত পর্যবেক্ষকদের।

কেরেম শালোম ক্রসিংয়ে ত্রাণের উপস্থিতি, কিন্তু বাস্তবায়ন অনিশ্চিত

রয়টার্সের খবরে জানা যায়, ইসরায়েল-গাজা সীমান্তবর্তী কেরেম শালোম ক্রসিংয়ে মানবিক সহায়তাবাহী বেশ কয়েকটি ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। তবে এখন পর্যন্ত এই ক্রসিং ব্যবহার করে গাজায় কার্যকরভাবে সহায়তা প্রবেশ করেছে কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

এছাড়া মিশরের আরিশ শহরে আরও সহায়তাবাহী ট্রাক লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে বাস্তবিকভাবে কবে, কী পরিমাণ সহায়তা গাজায় প্রবেশ করবে, তা এখনো অস্পষ্ট।

জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (UNRWA) চলতি মাসের শুরুতে জানায়, গাজার বাইরে ৩ হাজারের বেশি ত্রাণবাহী ট্রাক আটকে আছে। এর মধ্যে অনেক ট্রাকেই খাদ্য দ্রব্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

নেতানিয়াহুর ঘোষণা: গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চাই ইসরায়েল

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সম্প্রতি নিজের টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টে প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় বলেন, “আমরা গাজার পুরো নিয়ন্ত্রণ নেব। আমরা নিশ্চিত করব, এখানে হামাসের কেউ আর কোনোদিন ঢুকতে না পারে।”

এ বক্তব্য স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়, ইসরায়েলের লক্ষ্য এখন শুধু হামাসকে নির্মূল করা নয়—বরং গাজার প্রশাসনিক ও সামরিকভাবে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। এটি ফিলিস্তিনের ওপর দীর্ঘস্থায়ী দখলদারিত্বেরই আরেকটি রূপ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

মানবিক সংকটের বাস্তব চিত্র

গাজায় চলমান সংঘাত ও অবরোধের কারণে জনজীবন পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, গাজায় প্রায় ২২ লাখ মানুষ বসবাস করে। তাদের একটি বড় অংশ এখন অনাহার, অপুষ্টি, বিশুদ্ধ পানির অভাব, চিকিৎসাসেবা সংকট ও বাসস্থানহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) জানায়, গাজার অধিকাংশ পরিবার দিনে মাত্র একবার খাবার পাচ্ছে, তাও অনেক সময় পুষ্টিহীন। শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও চাপ

ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ত্রাণ প্রবেশের সিদ্ধান্তকে অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠন স্বাগত জানালেও এটিকে পর্যাপ্ত নয় বলে অভিহিত করেছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেওয়া একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, তবে অবরোধ তুলে দিয়ে মুক্তভাবে খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ চালু করাই একমাত্র টেকসই সমাধান।”

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও ইসরায়েলের ওপর চাপ দিচ্ছে, যেন তারা ত্রাণ সরবরাহে আরও নমনীয়তা দেখায়।

বিশ্লেষণ: মানবিকতা না ভূরাজনৈতিক কৌশল?

ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্তকে কেউ কেউ মানবিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখলেও বাস্তবতা হলো, এটি মূলত কৌশলগত পদক্ষেপ।

সমরনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, “ইসরায়েল ত্রাণ প্রবেশের মাধ্যমে একদিকে আন্তর্জাতিক চাপ কমাতে চায়, অন্যদিকে সেনা অভিযান অব্যাহত রাখতে চায়। আবার ত্রাণ বিতরণের মাধ্যমে তারা গাজায় প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।”

এই কৌশল যদি সফল হয়, তাহলে গাজায় হামাসের অনুপস্থিতিতে নতুন কোনো ‘ইসরায়েল-সমর্থিত’ শাসন কাঠামোর সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকরা।

গাজায় সাময়িকভাবে ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলেও মূল লক্ষ্য যে গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া—ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নিজেই তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এ সিদ্ধান্ত কতটা মানবিক, আর কতটা কৌশলগত, সে প্রশ্ন এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে ঘুরপাক খাচ্ছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, গাজার মানবিক সংকট কিছুটা প্রশমিত হলেও রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। শান্তি, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার স্বপ্ন এখনও ফিলিস্তিনিদের কাছে বহু দূরের।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button