বিশ্ব

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট শারাকে হত্যা না করতে যুক্তরাষ্ট্রকে জর্ডানের হুঁশিয়ারি

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার বৈঠকের আগেই হঠাৎ এক বিস্ফোরক তথ্য উঠে এসেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু অংশ সিরিয়ার বর্তমান নেতা শারাকে সরিয়ে দিতে চাইলেও, জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে এনেছেন মার্কিন সিনেটের প্রভাবশালী ডেমোক্রেট সদস্য জিন শাহিন।

এই ঘটনা এমন সময় সামনে এলো, যখন ট্রাম্প সিরিয়ার উপর দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও মার্কিন প্রশাসনের ভেতরে আলোড়ন তুলেছেন।

জর্ডানের বাদশাহর সতর্কবার্তা

গত বৃহস্পতিবার সিনেট শুনানিতে জিন শাহিন বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি সংশ্লিষ্ট কিছু মহলে শারাকে হত্যার একটি বিকল্প উদ্যোগের কথা আলোচনায় এসেছিল। এ বিষয়ে জানতে পেরে জর্ডানের বাদশাহ যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ার করে বলেন, এমন পদক্ষেপে সিরিয়ায় আবারও পূর্ণমাত্রার গৃহযুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

শাহিন আরও জানান, “বাদশাহ আবদুল্লাহ আমাদের সতর্ক করে বলেন, শারাকে হত্যার মতো কোনো উদ্যোগ বর্তমানে সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক অগ্রগতির সুযোগকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”

ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বন্দ্ব ও বিভাজন

এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে আসে—ট্রাম্প প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ বিভাজন। সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে প্রশাসনের ভেতরে মতভেদ স্পষ্ট হয়েছে। পররাষ্ট্র দপ্তরের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের (NSC) কট্টরপন্থী সদস্যরা শারার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন।

একজন মার্কিন কর্মকর্তা Middle East Eye-কে জানান, এমন পরিকল্পনা ছিল যাতে নিষেধাজ্ঞা তুলে না নিয়ে শারার কাছ থেকে কিছু কৌশলগত ছাড় আদায় করা যায়। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসনেরই কেউ কেউ প্রকাশ্যে বা গোপনে শারার নেতৃত্বে সিরিয়ার নতুন দিগন্তকে স্বাগত জানাচ্ছেন।

রিয়াদ বৈঠক ও শারার প্রশংসা

গত ১৪ মে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে ট্রাম্প ও শারার মধ্যে ঐতিহাসিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘এয়ার ফোর্স ওয়ান’-এ সাংবাদিকদের বলেন, “শারা একজন তরুণ, শক্তিশালী ও আকর্ষণীয় নেতা। তাঁর অতীত জোরালো। তিনি একজন যোদ্ধা।”

ট্রাম্প আরও বলেন, বিভিন্ন দেশের নেতারা তাঁকে অনুরোধ করেছেন যেন শারাকে একটি সুযোগ দেওয়া হয়। তবে তাঁর নিজের উপদেষ্টারা এ বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন।

নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে চমক

ট্রাম্প সিরিয়ার উপর থেকে দীর্ঘ ৪৬ বছরের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন, যা ১৯৭৯ সালে আরোপিত হয়েছিল। এই ঘোষণা রিয়াদ সম্মেলনে উপস্থিত অনেক দেশকে চমকে দিলেও, মার্কিন প্রশাসনের অনেকেই এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এমনকি পররাষ্ট্র দপ্তরের যেসব কর্মকর্তারা আগে শিথিলতার পক্ষে ছিলেন, তারাও বলছেন, হোয়াইট হাউস তাদের উপেক্ষা করেছে।

মিডল ইস্ট আই জানায়, মাত্র কয়েকদিন আগেও মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছিলেন, দামেস্কের বর্তমান প্রশাসনের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। সেই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের ঘোষণাকে “আচমকা ধাক্কা” হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে।

জোয়েল রেইবার্নের অবস্থান

সিনেট শুনানিতে ট্রাম্পের মনোনীত মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক আন্ডারসেক্রেটারি পদপ্রার্থী জোয়েল রেইবার্ন বলেন, “আমি শারাকে হত্যা করার কোনো উদ্যোগের কথা জানি না। তা প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক মন্তব্যের সঙ্গে মেলে না।”

জোয়েল রেইবার্ন, যিনি ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে সিরিয়ায় দূত ছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে শারাবিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন। তবে এখন তিনি ট্রাম্পের নতুন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “এটি এক সুবর্ণ সুযোগ… প্রেসিডেন্ট সাহসী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।”

শারার অতীত ও আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন

শারা এক সময় হায়াত তাহরির আল-শাম (HTS)-এর কমান্ডার ছিলেন এবং ২০২৪ সালে বাশার আল-আসাদ সরকার পতনে নেতৃত্ব দেন। তিনি এক সময় আল-কায়েদার অনুগত ছিলেন এবং ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশ নিয়ে কয়েক বছর যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে আটকও ছিলেন।

তার মাথার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এক সময় এক কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, যা ২০২৫ সালের শুরুর দিকে প্রত্যাহার করা হয়। তবে তাঁর নাম এখনো “গ্লোবাল টেররিস্ট” তালিকায় রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সেটিও পরিবর্তন হতে পারে।

আঞ্চলিক মিত্রতা ও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক

শারার ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ হলো তুরস্ক। তবে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলছে। ট্রাম্পও সরাসরি শারার সঙ্গে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

সিরিয়ার তথ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ পরিচালক আলী আল-রিফাই ইসরায়েলের ‘কান’ টেলিভিশনকে বলেন, “আমরা নিরঙ্কুশভাবে সবার সঙ্গে শান্তি চাই।”

ট্রাম্পও জানান, সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।

মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে কূটনৈতিক পুনঃসন্তুলন

ইসরায়েল ও সিরিয়ার মধ্যে চলমান উত্তেজনা কমাতে সংযুক্ত আরব আমিরাত পরোক্ষ আলোচনায় সক্রিয় রয়েছে। সিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কিছু অংশ এখনও ইসরায়েল দখলে রেখেছে এবং বারবার বিমান হামলা চালাচ্ছে।

ট্রাম্প প্রশাসন ইতোমধ্যে ইসরায়েল ও তুরস্কের মধ্যে সিরিয়া ইস্যুতে সংঘাত এড়ানোর কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করেছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button