ভারতের ‘চিকেনস নেক’ এর কাছে সামরিক মহড়া ‘তিস্তা প্রহার’

ভারতের পূর্বাঞ্চলের একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ভৌগলিক অঞ্চলে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো এক পূর্ণাঙ্গ সামরিক মহড়া— যার নামকরণ করা হয়েছে ‘তিস্তা প্রহার’। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত তিস্তা ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জে এই মহড়া সম্পন্ন হয় ৮ মে থেকে ১০ মে পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী। ভারতের সামরিক বাহিনীর মতে, এটি ছিল যুদ্ধকালীন প্রস্তুতির একটি বাস্তব অনুশীলন। তবে এই মহড়ার ভৌগলিক অবস্থান ও কৌশলগত প্রেক্ষাপট একে শুধুমাত্র একটি ‘রুটিন এক্সারসাইজ’-এর চেয়ে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।
কী ঘটেছে ‘তিস্তা প্রহার’ মহড়ায়?
এই মহড়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল— নদীবিধৌত ও ভূরাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল এলাকায় বাহিনীর সম্মিলিত যুদ্ধকৌশল এবং অপারেশনাল সক্ষমতা প্রদর্শন। ভারতীয় সেনাবাহিনী একে তাদের ‘জয়েন্ট কম্ব্যাট স্ট্র্যাটেজি’ এর অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
মহড়ায় অংশ নেয় সেনাবাহিনীর বিভিন্ন শাখা, যেখানে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, হেলিকপ্টার, ড্রোন, সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল এবং ভারী কামান ব্যবহার করা হয়। প্রকাশিত ভিডিও এবং ছবিগুলোতে সেনাবাহিনীর ‘ফাস্ট অ্যাটাক ফর্মেশন’ এবং ‘কুইক রিএকশন ক্যাপাবিলিটি’র অনুশীলন স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। এটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখানোর সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
কোথায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এই মহড়া?
যে অঞ্চলে মহড়াটি অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেটি ভারতের ‘চিকেনস নেক’ বা শিলিগুড়ি করিডরের নিকটবর্তী এলাকা। ভারতের মানচিত্রে এটি হলো একটি মাত্র ১৭ কিলোমিটার চওড়া সরু ভূখণ্ড, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এই করিডরটি কৌশলগতভাবে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এটি নিরাপত্তা হুমকিতে পড়লে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, শিলিগুড়ি করিডরের কাছাকাছি এ ধরনের একটি সামরিক মহড়া কেবল একটি প্রশিক্ষণ নয়, বরং এটি ভারতের ভূরাজনৈতিক বার্তাবাহক পদক্ষেপ বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
কেন এটি শুধুই ‘রুটিন এক্সারসাইজ’ নয়?
দিল্লির সেনাবাহিনীর একটি অভ্যন্তরীণ সূত্র বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, “এটি সাধারণ মহড়া নয়। কারণ, তিস্তা অববাহিকায় এতো বড় পরিসরে সামরিক অনুশীলন গত দশকে হয়নি। এটি সেনাবাহিনীর স্ট্র্যাটেজিক চর্চার অংশ।”
তাছাড়া মহড়ার সময় ও স্থান— উভয়ই অনেক বার্তা বহন করে। ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী চীন ও বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক এবং অঞ্চলগত সংবেদনশীলতা বিবেচনায় নিলে, মহড়াটিকে নিছক প্রশিক্ষণ হিসেবে দেখা সম্ভব নয়।
প্রতিবেশীদের প্রতি বার্তা?
লন্ডনভিত্তিক জিওপলিটিক্যাল বিশ্লেষক প্রিয়জিৎ দেব সরকার মনে করেন, এই মহড়ার মাধ্যমে ভারত স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে— তারা উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা রক্ষায় সর্বোচ্চ প্রস্তুত। তিনি বলেন, “এই মহড়ায় সূক্ষ্মভাবে প্ররোচনার উপাদানও আছে, যা হয়তো বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিশেষ করে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের কাছে স্বস্তিকর নয়।”
প্রিয়জিৎ আরও বলেন, “ভারতের এমন সামরিক প্রস্তুতির মধ্যে কেবলমাত্র নিজেদের প্রস্তুতি প্রদর্শন নয়, বরং এটি এক ধরনের প্রতিবেশী নিরীক্ষণ কৌশল— বিশেষ করে যখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে এবং চীন দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বাড়াতে চাইছে।”
চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রসঙ্গ
ভারত ও চীনের মধ্যকার উত্তেজনা বিশেষ করে লাদাখ ও অরুণাচল সীমান্তে বারবার চরম আকার ধারণ করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের সেনাবাহিনীর উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রস্তুতিগুলোর কৌশলগত গুরুত্ব বেড়ে গেছে। চিকেনস নেক অঞ্চলটি চীনের চোখেও অত্যন্ত কৌশলগত একটি এলাকা। সেখানে যে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা ভারতের অখণ্ডতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে তিস্তা অববাহিকায় বৃহৎ সামরিক মহড়া চীনের প্রতি এক ধরনের সতর্কবার্তা হিসেবেও ধরা যেতে পারে— যে ভারত কেবল সীমান্তে নয়, বরং দেশের অভ্যন্তরেও চরম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাৎপর্য
তিস্তা নদী দীর্ঘদিন ধরেই ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে একটি অমীমাংসিত ইস্যু। বাংলাদেশ বহুবার তিস্তা চুক্তির দাবিতে ভারতকে চাপে ফেলেছে, কিন্তু ভারত এখনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরে আগ্রহ দেখায়নি। এই প্রেক্ষাপটে ‘তিস্তা প্রহার’ নামকরণ এবং তিস্তার নদীবিধৌত অঞ্চলে মহড়ার আয়োজন অনেকের কাছেই বাংলাদেশের প্রতি একটি কৌশলগত বার্তা বলেই মনে হচ্ছে।
বিশেষ করে বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে, যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও কূটনৈতিক ভারসাম্য এখনো বিতর্কের কেন্দ্রে। ফলে এই সময়কালে ভারতের এমন পদক্ষেপ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেও প্রভাবিত করতে পারে।
উপসংহার
ভারতের ‘তিস্তা প্রহার’ নামক সামরিক মহড়া শুধুমাত্র একটি সামরিক প্রশিক্ষণ নয়, এটি একাধিক ভূরাজনৈতিক ইঙ্গিত বহন করছে। শিলিগুড়ি করিডরের কাছাকাছি অবস্থান, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের প্রদর্শন, সময়সীমার নির্বাচন এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নামকরণ— সবকিছু মিলিয়ে এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি সূক্ষ্ম কিন্তু দৃশ্যমান বার্তা।
এখন দেখার বিষয় হলো, এই মহড়ার পরে বাংলাদেশ, চীন ও অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়, এবং ভারত তাদের সামরিক ও কূটনৈতিক কৌশলে কী ধরনের পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।