বিশ্ব

কাতারে গিয়ে ২০০ বিলিয়ন ডলারের বোয়িং চুক্তি করলেন ট্রাম্প

কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিমান শিল্পে এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। মার্কিন বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং-এর সঙ্গে কাতার ১৬০টি বিমান ক্রয়ের একটি বিশাল চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার আনুমানিক মূল্য ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। বুধবার (১৪ মে) এই চুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হয় কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপস্থিতিতে।

ওয়াশিংটনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই চুক্তি স্বাক্ষরের সময় ট্রাম্প বলেন, “এটি একটি অসাধারণ দিন। আমরা ১৬০টি বিমানের একটি রেকর্ড চুক্তি করেছি, যার মূল্য ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এটি কেবল একটি বাণিজ্যিক অর্জন নয়, বরং এটি দু’দেশের অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বেরও এক শক্তিশালী নিদর্শন।”

তিনি আরও বলেন, “এই চুক্তির মাধ্যমে বোয়িং নতুন গতি পাবে। কেলি, এটি তো রেকর্ড—তাহলে বোয়িংকে অভিনন্দন।” বোয়িংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কেলি অর্টবার্গের উদ্দেশে এই মন্তব্য করে ট্রাম্প বোয়িংয়ের ভবিষ্যৎ উন্নতির প্রতি তাঁর প্রত্যাশাও প্রকাশ করেন।

বোয়িংয়ের জন্য নতুন সুযোগ

বিশ্বখ্যাত বিমান নির্মাতা বোয়িং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু সংকটে পড়েছিল। ২০২৪ সালের শুরুতে আলাস্কা এয়ারলাইনসের একটি বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স বিমানের মাঝ আকাশে দরজা খুলে যাওয়ার ভয়াবহ ঘটনার পর প্রতিষ্ঠানটি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। নিরাপত্তা ইস্যু এবং মান নিয়ন্ত্রণে ঘাটতির কারণে বোয়িংয়ের প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করে অনেক বিমান সংস্থা।

উক্ত ঘটনার পর বোয়িংয়ের অর্ডার উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। ২০২৪ সালের পুরো বছরজুড়ে তাদের মোট গ্রস অর্ডার ছিল মাত্র ৫৬৯টি, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৬০ শতাংশ কম। এমন পরিস্থিতিতে কাতারের এই নতুন অর্ডার বোয়িংয়ের জন্য এক বিশাল প্রাপ্তি এবং সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করল।

উৎপাদন সংকট ও শ্রমিক ধর্মঘট

চলতি সংকটের পাশাপাশি বোয়িং ২০২৪ সালে একটি বড় শ্রমিক ধর্মঘটের মুখে পড়ে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় তিন মাসেরও বেশি সময় উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ধর্মঘটে অংশ নেন প্রায় ৩৩ হাজার শ্রমিক, যা বোয়িংয়ের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ শিল্প বিরতি।

এই কারণে ২০২৪ সালে বোয়িং মাত্র ৩৪৮টি বিমান সরবরাহ করতে সক্ষম হয়, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৩৪ শতাংশ কম। এমন প্রেক্ষাপটে কাতার এয়ারওয়েজের কাছ থেকে পাওয়া ১৬০টি বিমানের অর্ডার বোয়িংয়ের উৎপাদন সক্ষমতা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা পুনর্গঠনে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ট্রাম্পের শুল্ক নীতির প্রভাব

তবে বোয়িংয়ের সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি অনেকটা অপ্রত্যাশিত চাপ তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ‘লিবারেশন ডে’ শুল্ক এবং বিদেশি পাল্টা শুল্কের কারণে বিমান তৈরির যন্ত্রাংশ আমদানির খরচ বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে বোয়িংয়ের উৎপাদন ব্যয় অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এই শুল্ক নীতি বোয়িংয়ের মতো বড় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি দ্বৈত বাস্তবতা তৈরি করছে—একদিকে বৃহৎ অর্ডার, অন্যদিকে উৎপাদন ব্যয় ও শুল্কজনিত বাধা।

কাতারের কৌশলগত বিনিয়োগ

বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্র কাতার, বিশেষত তাদের জাতীয় বিমান সংস্থা কাতার এয়ারওয়েজ গত এক দশকে আন্তর্জাতিক এভিয়েশন খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী এই এয়ারলাইন্স ইতিমধ্যেই বিশ্বের বহু গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে এবং বোয়িংয়ের এই নতুন ১৬০টি বিমান ভবিষ্যতে তাদের বহরকে আরও সমৃদ্ধ করবে।

এই চুক্তির মাধ্যমে কাতার বোয়িংয়ের ৭৮৭ ড্রিমলাইনার, ৭৭৭এক্স এবং ৭৩৭ ম্যাক্স সিরিজের একাধিক মডেল অর্ডার করেছে বলে জানা গেছে। বিমানগুলো পর্যায়ক্রমে কাতার এয়ারওয়েজের বহরে যুক্ত হবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে।

চুক্তির ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

এই ধরনের বৃহৎ চুক্তি কেবল অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্বও বিশাল। যুক্তরাষ্ট্র এবং কাতারের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার পাশাপাশি এটি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের একটি অংশ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের মিত্রদের সঙ্গে এই ধরনের উচ্চমূল্যের বাণিজ্যিক ও কৌশলগত চুক্তি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button