যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের রেকর্ড ১৪২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি সই

যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ সামরিক চুক্তি, যার আনুমানিক মূল্য ১৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। হোয়াইট হাউস একে ‘ইতিহাসের বৃহত্তম প্রতিরক্ষা বিক্রয় চুক্তি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এই চুক্তির আওতায় সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বাধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম, প্রযুক্তি এবং সামরিক সেবা পাবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চুক্তি শুধু প্রতিরক্ষা খাতে নয়, বরং দুই দেশের কৌশলগত অংশীদারিত্বকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
রাজকীয় অভ্যর্থনা ও কূটনৈতিক আলাপচারিতা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার সৌদি রাজধানী রিয়াদে পৌঁছালে তাকে রাজকীয় মর্যাদায় বরণ করে নেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। বিমানবন্দরে ছিল বেগুনি গালিচা সংবর্ধনা, যা দেশটির সবচেয়ে সম্মানজনক অভ্যর্থনার প্রতীক। সৌদি রাজার রাজকীয় প্রাসাদে তাঁকে দেওয়া হয় ‘গার্ড অব অনার’। সৌদি রাজপরিবারের সদস্য এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা এই সময় উপস্থিত ছিলেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টামণ্ডলী এবং যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবসায়ী নেতারা। উভয় পক্ষ এক যৌথ বৈঠকে বসেন, যেখানে বাণিজ্য, জ্বালানি, নিরাপত্তা এবং কৌশলগত সম্পর্কের উপর আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে দু’দেশের মধ্যে মোট ৬০০ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও সহযোগিতা বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়, যার মধ্যে ১৪২ বিলিয়ন ডলার শুধু প্রতিরক্ষা খাতেই।
আধুনিক প্রযুক্তি ও যুদ্ধ সরঞ্জামের প্রতিশ্রুতি
এই চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের এক ডজনেরও বেশি প্রতিরক্ষা কোম্পানি সৌদি আরবকে যে সরঞ্জাম সরবরাহ করবে, তার মধ্যে রয়েছে আধুনিক ফাইটার জেট, প্যাট্রিয়ট মিসাইল সিস্টেম, আর্মড ড্রোন, সাইবার প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি এবং যুদ্ধ প্রশিক্ষণ সেবা। মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এসব সরঞ্জাম সরবরাহের মাধ্যমে সৌদি আরব তার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি করবে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, “পৃথিবীতে আমরাই সেরা সামরিক সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী দেশ। ফাইটার জেট, মিসাইল সিস্টেম, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি—সব ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বসেরা। সৌদি আরব আমাদের কাছ থেকে এই অত্যাধুনিক সরঞ্জাম ক্রয় করে তাদের সামরিক শক্তিকে আরও আধুনিক করতে চায়—এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে।”
সৌদি আরবের ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য
বিশ্লেষকদের মতে, এই চুক্তি কেবল সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা খাতের উন্নয়নের জন্য নয়, বরং তাদের সামগ্রিক কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে সৌদি আরব নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে সচেষ্ট। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের সঙ্গে বৈরিতা, ইয়েমেনে সংঘর্ষ, এবং হুথি বিদ্রোহীদের আক্রমণ—সবকিছুর প্রেক্ষাপটে সৌদি আরব আধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।
ইতিপূর্বে সৌদি আরব ঘোষণা দিয়েছিল ‘ভিশন ২০৩০’ পরিকল্পনার আওতায় তারা তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বহুমুখীকরণের পথে হাঁটবে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রতিরক্ষা শিল্পেও বড় ধরনের বিনিয়োগ করার কথা জানিয়েছে দেশটি। এ চুক্তির মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের দিকে বড় পদক্ষেপ নেওয়া হলো।
কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রভাব
এই বিশাল প্রতিরক্ষা চুক্তি কেবল সামরিক দিক থেকেই নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও দুই দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক হাজার নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। পাশাপাশি, সৌদি আরবেও সামরিক প্রযুক্তির স্থানীয় উৎপাদন এবং রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রে বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ধরনের চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্প আরও চাঙ্গা হবে এবং সৌদি আরবও তাদের প্রতিরক্ষা খাতে স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাবে।
কূটনৈতিক বার্তা ও ভূরাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
চুক্তিটি শুধু প্রতিরক্ষা কিংবা অর্থনৈতিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি একটি কূটনৈতিক বার্তাও বহন করে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অংশীদার সৌদি আরব। গত কয়েক বছরে কিছু সম্পর্কের টানাপোড়েন থাকলেও এই চুক্তি প্রমাণ করে দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক এখনও শক্তিশালী।
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশ এই চুক্তির দিকে নজর রাখছে। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া, যারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে, তাদের জন্য এটি একটি কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হতে পারে। একইসাথে, ইরানের জন্য এটি উদ্বেগজনক এক বার্তা হতে পারে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সামরিক ঘনিষ্ঠতা মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে পারে।
উপসংহার
যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরবের মধ্যে এই ১৪২ বিলিয়ন ডলারের সামরিক চুক্তি ইতিহাসে নজিরবিহীন। এটি শুধু দুটি দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার নয়, বরং কৌশলগত মিত্রতারও প্রতীক। ট্রাম্প প্রশাসনের এই উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্পকে চাঙ্গা করবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের কৌশলগত অবস্থানকে আরও দৃঢ় করবে।