বিশ্ব

জাপানি গাড়ি নির্মাতা নিসান আরও ১০ হাজার কর্মী ছাঁটাই করবে

জাপানের অন্যতম বৃহৎ গাড়ি নির্মাতা নিসান বিশ্বজুড়ে আরও দশ হাজারেরও বেশি কর্মী ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই নতুন ছাঁটাই প্রক্রিয়ার ফলে কোম্পানিটির পূর্বঘোষিত কর্মী ছাঁটাইয়ের মোট সংখ্যা প্রায় ২০ হাজারে উন্নীত হবে, যা নিসানের মোট কর্মীর প্রায় ১৫ শতাংশ। জাপানের সরকারি সম্প্রচার মাধ্যম এনএইচকে সোমবার এই চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছে, যা বৈশ্বিক অটোমোবাইল শিল্পে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘদিনের আর্থিক সংকটে জর্জরিত নিসানের এই পদক্ষেপ বিশ্ব অর্থনীতিতে, বিশেষ করে গাড়ি উৎপাদন খাতে, অস্থিরতার ইঙ্গিত বহন করছে এবং শিল্পজুড়ে এক ধরনের শকওয়েভ তৈরি করেছে। এই গণছাঁটাই নিসানের ভবিষ্যৎ কৌশল এবং বাজারে তাদের অবস্থান নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।

বর্তমানে তীব্র আর্থিক ধুঁকতে থাকা জাপানি এই গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিটি গত মাসেই তাদের আর্থিক অবস্থার গুরুতর অবনতির বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছিল। কোম্পানি পূর্বাভাস দিয়েছে যে, মার্চ মাসে শেষ হওয়া আর্থিক বছরে তারা রেকর্ড ৭০০ বিলিয়ন ইয়েন থেকে ৭৫০ বিলিয়ন ইয়েন পর্যন্ত নিট লোকসানের সম্মুখীন হবে। যা মার্কিন ডলারের হিসেবে প্রায় ৪ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন থেকে ৫ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলারের সমান। বাংলাদেশের মুদ্রায় এই বিপুল পরিমাণ লোকসান প্রায় ৫৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা থেকে ৬২ হাজার কোটি টাকার (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে) মতো, যা দেশের অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে এক বিশাল অঙ্ক এবং নিসানের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বার্ষিক লোকসান। এই বিপুল পরিমাণ লোকসান নিসানের বিগত বছরগুলোর আর্থিক সংকটের গভীরতাকেই তুলে ধরে এবং তাদের বিদ্যমান কৌশলগত দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে তোলে। এটি নিসানের জন্য কেবল একটি আর্থিক ধাক্কা নয়, বরং কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ এবং বাজার কৌশলের ব্যর্থতারও একটি বড় প্রতিফলন।

নিসান আগামীকাল মঙ্গলবার তাদের পূর্ণ বছরের আর্থিক ফলাফল ঘোষণা করার কথা থাকলেও, এই ছাঁটাই এবং আর্থিক লোকসানের বিষয়ে কোম্পানিটির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে। সাধারণত, বৃহৎ কর্পোরেশনগুলো এমন পরিস্থিতিতে সরাসরি মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে, যতক্ষণ না তাদের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। তবে এনএইচকে-এর এই প্রতিবেদন শিল্প মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং বিনিয়োগকারী ও বিশ্লেষকদের মধ্যে নিসানের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে জল্পনা শুরু হয়েছে। এটি নিসানের শেয়ার মূল্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নিসানের সবচেয়ে বড় বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে তাদের ব্যবসা গত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে। মার্কিন বাজারে নিসানের এই ব্যাপক ক্ষতির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে নতুন হাইব্রিড গাড়ির অভাব এবং পুরোনো মডেলের লাইনআপকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্ববাজারে যেখানে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হাইব্রিড এবং ইলেকট্রিক গাড়ির চাহিদা তুঙ্গে, সেখানে নিসানের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে পিছিয়ে থাকা তাদের বিক্রিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ভোক্তাদের রুচি ও চাহিদার পরিবর্তনকে ধরতে না পারা এবং প্রতিযোগীদের তুলনায় নতুন প্রযুক্তির গাড়ি উৎপাদনে ধীর গতিই নিসানের এই দুর্দশার মূল কারণ বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। মার্কিন বাজারে যেখানে পিকআপ ট্রাক এবং এসইউভির মতো বৃহৎ গাড়ির চাহিদা বেশি, সেখানে নিসানের পুরানো মডেলগুলো আর আকর্ষণ ধরে রাখতে পারছে না। অন্যদিকে, ফোর্ড, জেনারেল মোটরস এবং টয়োটার মতো প্রতিযোগীরা দ্রুত হাইব্রিড ও ইলেকট্রিক মডেল বাজারে এনে বাজার দখল করে নিচ্ছে।

কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, চীনের বাজারেও নিসান তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে ধুঁকছে। বিশ্বের বৃহত্তম এই অটোমোবাইল বাজারে একসময় নিসানের শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও, সম্প্রতি স্থানীয় ব্র্যান্ড এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীদের কাছ থেকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হচ্ছে তারা। চীনা ভোক্তারা এখন দ্রুত উদ্ভাবিত প্রযুক্তি, বিশেষ করে ইলেকট্রিক গাড়ির দিকে ঝুঁকেছেন, যেখানে নিসানের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে দুর্বল। চীনের বাজারেও পরিস্থিতি ভিন্ন নয়। সেখানে ইলেকট্রিক গাড়ির ক্ষেত্রে বিওয়াইডি (BYD) এবং নিও (Nio)-এর মতো স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর আগ্রাসী নীতি এবং দ্রুত উদ্ভাবনী সক্ষমতা নিসানের ঐতিহ্যবাহী আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। চীনা ভোক্তারা এখন স্মার্ট ফিচার এবং দীর্ঘ রেঞ্জের ইলেকট্রিক গাড়ির দিকে বেশি ঝুঁকছেন, যেখানে নিসান এখনো প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে আসতে পারেনি। এর ফলে চীনের বাজারেও তাদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নিসান আগামী বছরগুলোতে প্রায় ১০টি নতুন গাড়ি চালু করার মাধ্যমে বিক্রি বাড়িয়ে তাদের পতন বা লোকসান থামানোর চেষ্টা করছে। এর মধ্যে হাইব্রিড এবং ইলেকট্রিক মডেলের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কর্মী ছাঁটাইয়ের এই সিদ্ধান্ত নিসানের দীর্ঘমেয়াদী পুনর্গঠন পরিকল্পনারই অংশ। গত বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী নিসানের ১ লাখ ৩৩ হাজারেরও বেশি জনবল ছিল। এরপর কোম্পানিটি পুনর্গঠন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী তাদের উৎপাদন সক্ষমতা ২০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। এই নতুন ১০ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা সেই পরিকল্পনারই সম্প্রসারিত রূপ। এত বিশাল সংখ্যক কর্মীর ছাঁটাই কেবল নিসানের জন্য নয়, বরং বিশ্বজুড়ে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর জন্যও এক বড় বিপর্যয় বয়ে আনবে। এটি কর্মসংস্থান বাজারেও এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে, যেসব অঞ্চলে নিসানের বৃহৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে, সেখানে স্থানীয় অর্থনীতিতে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে। কর্মীদের মানসিকতা এবং কোম্পানির উৎপাদনশীলতার ওপরও এর একটি বড় ধরনের প্রভাব পড়া স্বাভাবিক, যা নিসানের পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

বৈশ্বিক অটোমোবাইল শিল্প বর্তমানে এক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইলেকট্রিক গাড়ির দিকে ভোক্তাদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, সেমিকন্ডাক্টর চিপের সংকট এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাতের মতো একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এই শিল্প। নিসানের মতো ঐতিহ্যবাহী গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলো এই পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে। ফোর্ড, জেনারেল মোটরস এবং টয়োটার মতো অন্যান্য বড় গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলোও তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং বাজার কৌশল পরিবর্তন করছে, যা এই খাতের প্রতিযোগিতাকে আরও তীব্র করে তুলেছে। এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নিসান শুধু কর্মী ছাঁটাই নয়, বরং তাদের উৎপাদন সক্ষমতা হ্রাস, কিছু মডেলের উৎপাদন বন্ধ এবং নির্দিষ্ট কিছু ভৌগোলিক বাজার থেকে সরে আসার মতো কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে পারে। আগামী বছরগুলোতে ১০টি নতুন গাড়ি বাজারে আনার পরিকল্পনা নিসানের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। কারণ, বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নতুন মডেলগুলো কতটা দ্রুত ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করতে পারে এবং তাদের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় কতটা এগিয়ে থাকে, তার উপরই কোম্পানির ভবিষ্যৎ অনেকটা নির্ভর করবে। বিশেষ করে, ইলেকট্রিক ও হাইব্রিড প্রযুক্তিতে নিসানের বিনিয়োগ এবং গবেষণা-উন্নয়ন (R&D) কতটা কার্যকর হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

নিসানের এই কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা শুধু তাদের অভ্যন্তরীণ সংকটই নয়, এটি বৈশ্বিক অটোমোবাইল শিল্পের অস্থিরতা এবং ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশেরও একটি প্রতিচ্ছবি। নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে না পারলে এবং বাজার চাহিদা অনুযায়ী উদ্ভাবনী পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে, বড় বড় কোম্পানিগুলোকেও যে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, নিসানের বর্তমান অবস্থাই তার প্রমাণ। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে নিসান হয়তো নিজেদের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা এবং লাভজনকতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে, তবে এই পথ অত্যন্ত কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তীব্র প্রতিযোগিতা, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার এই সময়ে নিসানের মতো একটি বৃহৎ কোম্পানির টিকে থাকা এবং লাভজনক অবস্থায় ফিরে আসা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। আগামী দিনগুলোতে নিসানের নতুন গাড়ির মডেল এবং তাদের বাজার কৌশল কতটা সফল হয়, তার উপরই নির্ভর করছে এই জাপানি গাড়ি নির্মাতার ভবিষ্যৎ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button