বিশ্ব

গাজায় স্কুলে ইসরায়েলি বিমান হামলায় আরও ২৯ নিহত

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর সাম্প্রতিক বিমান হামলায় ফের রক্তাক্ত হলো স্কুল ভবন। এক দিনের ব্যবধানে আরও ২৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই সাধারণ নাগরিক ও শরণার্থী। আহত হয়েছেন অন্তত ৯৪ জন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

স্কুলে বিমান হামলায় প্রাণ গেল ১৫ জনের, শিশুদের আর্তনাদ

আল-জাজিরার বরাতে ইরানের মেহের নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান সোমবার গাজার উত্তরাঞ্চলীয় জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের একটি বালিকা বিদ্যালয়ে ধারাবাহিক বোমা হামলা চালায়। ওই স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলেন গৃহহীন বহু শরণার্থী। হামলার সময় ভবনের ভেতরে অবস্থানরত অন্তত ১৫ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকালবেলা শান্ত পরিবেশে স্কুল প্রাঙ্গণে কিছু পরিবার রান্নাবান্না করছিলেন, কিছু শিশু খেলছিল। হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো ভবন। চারপাশ ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। অনেকে ঘটনাস্থলেই নিহত হন, আর বাকিরা গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

আগের হামলায় উদ্ধার ৪ মরদেহ, মোট নিহত ২৯

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে জানানো হয়, গেল কয়েক দিনের পুরনো ধ্বংসস্তূপ সরানোর সময় আরও চারটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ফলে গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় মোট ২৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৯৪ জন। যেকোনো সময় এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

৭ অক্টোবরের পর থেকে নিহতের সংখ্যা ছাড়াল ৫২ হাজার

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি আগ্রাসনে এ পর্যন্ত গাজায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২,৮৬২ জনে। আহত হয়েছেন ১,১৯,৬৪৮ জন

এছাড়া গত ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের পর থেকে এখন পর্যন্ত ২,৭৪৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৭,৬০৭ জন। প্রতিদিনের হিসাবেই গড়ে গাজায় প্রাণ হারাচ্ছে ৪০-৫০ জন সাধারণ মানুষ।

শিশু ও নারীর ওপর হামলা নিয়ে উদ্বেগ

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলের এই ধরণের হামলাকে “বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ” হিসেবে উল্লেখ করছে। গাজার স্কুল ও হাসপাতাল লক্ষ্য করে ধারাবাহিক বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ জানায়, ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় প্রায় ১৪ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। যারা বেঁচে আছে, তাদের জীবন এখন কঠিন খাদ্যসংকট, মানসিক আঘাত ও চিকিৎসাসেবার অভাবে বিপর্যস্ত।

জাবালিয়া শিবিরে ভয়াবহ অবস্থা, ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়া মানুষ

জাবালিয়া গাজার অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শরণার্থী শিবির। সেখানে একাধিকবার ইসরায়েলি হামলার শিকার হয়েছে স্কুল, বাজার ও আবাসিক ভবন। সোমবারের এই হামলায় ভবনের বড় অংশ ধসে পড়েছে। এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে অনেকেই আটকা পড়েছেন বলে স্থানীয় উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী মুস্তফা হাম্মাদ বলেন, “আমি নিজের চোখে দেখেছি, একজন মা তার দুটি সন্তানের মৃতদেহ কোলে নিয়ে বসে কাঁদছেন। আমরা কী দোষ করেছিলাম? কেন আমাদের বাচ্চাদের মেরে ফেলা হচ্ছে?”

ইসরায়েল বলছে ‘হামাস যোদ্ধা লক্ষ্য ছিল’, বাস্তবতা বলছে উল্টো

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (IDF) দাবি করেছে, তাদের লক্ষ্য ছিল গাজায় অবস্থানরত ‘সন্ত্রাসী’ যোদ্ধা। তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তদন্ত অনুযায়ী, এসব হামলায় নিহতদের অধিকাংশই বেসামরিক সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারী ও শিশু।

গাজার স্বাস্থ্যকর্মীরা জানাচ্ছেন, হামলার সময় কোনো ধরনের সামরিক ঘাঁটি বা অস্ত্রের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি ওই স্কুলে। এতে স্পষ্ট, এই হামলা একটি নিষ্ঠুর বেসামরিক আক্রমণ।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: যুদ্ধাপরাধ তদন্তের দাবি

ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়াসহ একাধিক দেশ ইসরায়েলের এই আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এ হামলার ব্যাপারে তদন্ত করে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মুখপাত্র বলেন, “ইসরায়েল গাজায় যা করছে, তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে। স্কুলে হামলা যুদ্ধাপরাধের শামিল।”

মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা, সংকট আরও গভীর

বর্তমানে গাজায় খাবার, পানি ও চিকিৎসার ঘাটতি চরমে। ইসরায়েলি অবরোধের কারণে আন্তর্জাতিক সহায়তাও আটকে আছে সীমান্তে। ইউএনআরডব্লিউএ জানায়, তাদের জরুরি সহায়তা ট্রাকগুলো দিনের পর দিন কেরেম শালোম ও রাফা সীমান্তে আটকে থাকছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি এই মানবিক সংকট আরও দীর্ঘায়িত হয়, তবে গাজায় এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় অনিবার্য।

সারসংক্ষেপ:

তথ্যপরিমাণ
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নিহত২৯ জন
আহত৯৪ জন
স্কুলে বিমান হামলায় নিহত১৫ জন
৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে নিহত৫২,৮৬২ জন
যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের পর নিহত২,৭৪৯ জন
বর্তমানে আহতের মোট সংখ্যা১,১৯,৬৪৮ জন
মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button