বিশ্ব

যুদ্ধ বন্ধে পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় রাজি জেলেনস্কি

রাশিয়ার সঙ্গে চলমান দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শান্তির আলো দেখতে চাচ্ছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। যুদ্ধ বন্ধে আলোচনার পথ বেছে নিতে প্রস্তুত তিনি। আগামী বৃহস্পতিবার (১৫ মে) তুরস্কে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকে বসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন জেলেনস্কি। ইউক্রেনের সংবাদমাধ্যম ‘দ্য কিয়েভ ইন্ডিপেনডেন্ট’ বরাতে এ তথ্য জানা গেছে।

জেলেনস্কি বলেন, “হত্যাকাণ্ড দীর্ঘায়িত করার কোনো মানে হয় না। আমি বৃহস্পতিবার তুরস্কে পুতিনের জন্য অপেক্ষা করব।” তিনি আরও বলেন, “আমরা আগামীকাল থেকে একটি সম্পূর্ণ এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতি আশা করছি, যা ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক আলোচনার জন্য প্রয়োজনীয় ভিত্তি তৈরি করবে।”

যুদ্ধের ক্লান্তি ও আলোচনার প্রয়াস

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু হয়েছিল ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান এ সংঘাতে লক্ষাধিক প্রাণহানি হয়েছে, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। যুদ্ধের বিস্তার শুধু ইউক্রেন নয়, গোটা ইউরোপজুড়ে নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা বিশ্ব এই সংঘাতকে একদিকে যেমন মানবিক সংকট হিসেবে দেখছে, অন্যদিকে এটি ভূরাজনৈতিক প্রভাব ফেলেছে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও।

এই পরিস্থিতিতে একাধিকবার যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা করা হলেও তা ব্যর্থ হয়েছে। তবে এই প্রথমবারের মতো দুই দেশের প্রেসিডেন্টের মুখোমুখি বৈঠকের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ট্রাম্পের প্রত্যক্ষ চাপ ও পরামর্শ

এদিকে, আলোচনার জন্য প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ওপর পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ স্যোশাল’-এ দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেছেন, ‘‘রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের সঙ্গে কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি চান না। এর পরিবর্তে তিনি বৃহস্পতিবার তুরস্কে সরাসরি সাক্ষাতে রক্তবন্যার অবসানে আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। রুশ প্রেসিডেন্টের এই প্রস্তাবে ইউক্রেনের তাৎক্ষণিকভাবে রাজি হওয়া উচিত।’’

ট্রাম্প আরও বলেন, “ইস্তাম্বুলে সাক্ষাতে আলোচনায় কোনো চুক্তির সম্ভাবনা আছে কি না, তারা অন্তত তা বুঝতে পারবেন। আর যদি না থাকে, তাহলে ইউরোপীয় নেতারা এবং যুক্তরাষ্ট্র জানতে পারবে আসলে কোন পরিস্থিতিতে আছে বিষয়টি এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে।”

যুদ্ধবিরতির পূর্বশর্ত ও কৌশল

তবে আলোচনা শুরুর আগে ইউক্রেন কিছু স্পষ্ট পূর্বশর্ত দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো রাশিয়ার পক্ষ থেকে কমপক্ষে ৩০ দিনের একটি আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি। গত সপ্তাহে ইউক্রেন এই দাবি তুলেছে, যাতে আলোচনার একটি বাস্তবসম্মত ও স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়। জেলেনস্কি মনে করেন, যেকোনো সমঝোতা কেবল যুদ্ধ থামানো এবং জনগণের প্রাণ রক্ষা করার মাধ্যমে সম্ভব।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব একদিকে যেমন আলোচনার দরজা খুলে দিচ্ছে, অন্যদিকে এটি পশ্চিমা মিত্রদের দিক থেকেও সমর্থন আদায়ের একটি কৌশল হতে পারে। কেননা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো সদস্যরাও এই যুদ্ধে সরাসরি না জড়ালেও অস্ত্র ও অর্থ সহায়তার মাধ্যমে যুক্ত রয়েছে।

রাশিয়ার অবস্থান ও সম্ভাব্য বাধা

অন্যদিকে, রাশিয়ার পক্ষ থেকে এখনো পুতিনের এই আলোচনায় অংশ নেওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানানো হয়নি। যদিও ট্রাম্পের দাবি অনুযায়ী, পুতিন এই আলোচনায় আগ্রহী, তবে রাশিয়ার সরকারি কোনো সূত্র এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেয়নি।

রাশিয়া এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের বার্ষিকী উদযাপন করছে। এ উপলক্ষে পুতিনের সময়সূচি ব্যস্ত থাকলেও এমন একটি আলোচনায় অংশ নেওয়া সম্ভব বলে অনেক কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। তবে ইউক্রেনের সঙ্গে শর্তহীন আলোচনায় বসা পুতিনের রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য সহজ হবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই আলোচনার সম্ভাবনায় আন্তর্জাতিকভাবে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটো ইতোমধ্যেই এই বৈঠককে স্বাগত জানিয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন, “দুই দেশের শীর্ষ নেতার মধ্যে সরাসরি আলোচনার চেষ্টা বিশ্বশান্তির পথে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি।”

জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁও উভয়ে আলাদাভাবে এই সম্ভাব্য বৈঠকের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক উদ্যোগই একমাত্র দীর্ঘস্থায়ী সমাধান।

ইউক্রেনের জনগণের প্রতিক্রিয়া

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের সাধারণ জনগণের মাঝে এই খবরে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। দেশটির রাজধানী কিয়েভসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষ শান্তির সম্ভাবনায় আশাবাদী হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ, শরণার্থী সংকট, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও জীবনের অনিশ্চয়তার মধ্যে মানুষের একটাই প্রত্যাশা—এ যুদ্ধ যেন শেষ হয়।

একজন কিয়েভবাসী বলেন, “আমরা এখন আর কারও জয় বা পরাজয় দেখতে চাই না। আমরা চাই শিশুরা নিরাপদে ঘুমাক, পরিবারগুলো একসঙ্গে থাকুক, আর ভবিষ্যতের কথা ভাবা সম্ভব হোক।”

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

জেলেনস্কি-পুতিন বৈঠক আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কি না, তা নির্ভর করছে উভয় দেশের আন্তরিকতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। তবে এটি সত্য যে, এই বৈঠকের সম্ভাবনাই যুদ্ধ-ক্লান্ত বিশ্বকে কিছুটা আশাবাদী করে তুলেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি বৃহস্পতিবার ইস্তাম্বুলে এই বৈঠক সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে তা হতে পারে একটি ঐতিহাসিক কূটনৈতিক অগ্রগতি। যদিও বাস্তবতায় এখনো বহু বাধা রয়েছে, তবুও শান্তির দিকে এই অগ্রযাত্রা বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button