বিশ্ব

৪০০ তুর্কি ড্রোন দিয়ে হামলা করেছে পাকিস্তান, দাবি ভারতের

ভারতের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, পাকিস্তান প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০টি তুর্কি ড্রোন ব্যবহার করে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় সুনির্দিষ্টভাবে হামলা চালিয়েছে। শুক্রবার (৯ মে) সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান ভারতের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল সোফিয়া কুরেশি। তিনি জানান, জম্মু ও কাশ্মীর, রাজস্থান, পাঞ্জাব এবং পাঠানকোটসহ অন্তত ৩৬টি শহরে এই ড্রোনগুলো লক্ষ্য করে পাঠানো হয়েছিল।

কর্নেল কুরেশি দাবি করেন, ভারতের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সময়মতো প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে সমস্ত ড্রোন সফলভাবে ভূপাতিত বা নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়েছে। এতে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়েছে। তবে ঘটনাটি ভারতের নিরাপত্তার ওপর একটি মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং এই হামলাকে যুদ্ধবিরতি চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করেছে নয়াদিল্লি।

বিস্তৃত এলাকায় ড্রোন উপস্থিতি

এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলার পর ড্রোনগুলোকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। এমনকি লাদাখ অঞ্চলের সিয়াচেন হিমবাহ বেস ক্যাম্প এবং গুজরাটের কচ্ছ এলাকাতেও পাকিস্তানি ড্রোন শনাক্ত করা হয়। এই দুটি স্থানের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার দূরত্ব রয়েছে, যা স্পষ্ট করে এই হামলার পরিসর কতটা বিস্তৃত ছিল। বিশ্লেষকদের মতে, এটি কেবল সীমান্তবর্তী এলাকার জন্য নয়, বরং দেশের অভ্যন্তরেও নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করেছে।

প্রযুক্তিগত প্রতিরোধ

ভারতের সামরিক বাহিনী জানায়, প্রায় পঞ্চাশটি ড্রোন বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গোলায় ধ্বংস করা হয়েছে। আরও বিশটি ড্রোনকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এই সফল প্রতিরক্ষার কারণে ভারত বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে বলে মন্তব্য করেন কর্নেল কুরেশি।

তিনি আরও বলেন, “এত সংখ্যক ড্রোন পাঠানো একধরনের সামরিক মনোভাব এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উস্কানি। এগুলো সামরিক অবকাঠামো পর্যবেক্ষণ ও আক্রমণ করার উদ্দেশ্যেই পাঠানো হয়েছিল। এটি সরাসরি যুদ্ধবিরতি চুক্তির লঙ্ঘন।”

পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়া

এদিকে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে ভারতের এ দাবি পুরোপুরি অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, ভারতের এই অভিযোগ ভিত্তিহীন, মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ইসলামাবাদ দাবি করেছে, ড্রোন হামলার এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি এবং এটি ভারতের তৈরি করা একটি ‘ভুয়া প্রচার’।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত এই ধরনের অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক মনোযোগ সরাতে চাচ্ছে। বিশেষ করে জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে সাম্প্রতিক সামরিক অভিযান এবং বেসামরিক মানুষের মৃত্যু প্রসঙ্গ থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে চাচ্ছে নয়াদিল্লি।

ব্যবহৃত ড্রোনের ধরন

এনডিটিভির প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, পাকিস্তান এই হামলায় তুরস্কে তৈরি ‘আ্যাসিগার্ড সঙ্গার’ নামের ড্রোন ব্যবহার করেছে। প্রস্তুতকারী সংস্থার মতে, এই ড্রোনগুলো দিনে ও রাতে কার্যকরভাবে নজরদারি ও সামরিক অভিযান চালাতে সক্ষম। এগুলোর কার্যক্ষম পাল্লা প্রায় ৫ কিলোমিটার এবং সেগুলোর অধিকাংশেই ক্যামেরা সংযুক্ত ছিল, যা সরাসরি গ্রাউন্ড স্টেশনে ছবি ও ভিডিও পাঠাতে সক্ষম।

এই ড্রোনগুলো মূলত নজরদারি ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যবহৃত হলেও বড় পরিসরে ব্যবহারের মাধ্যমে এগুলোর সক্ষমতা এবং আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ড্রোনগুলো ভবিষ্যতে অস্ত্র বহন করতেও সক্ষম হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে।

সামরিক ক্ষয়ক্ষতি ও নিরাপত্তা উদ্বেগ

কর্নেল কুরেশি জানান, ড্রোন হামলার পাশাপাশি জম্মু ও কাশ্মীর সীমান্তজুড়ে ছোট অস্ত্রের গুলিবর্ষণ এবং কামানের গোলাবর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। এতে এখন পর্যন্ত ১৬ জন ভারতীয় নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে একজন সেনাসদস্যও রয়েছেন।

তিনি বলেন, “যদিও ড্রোনগুলোতে কোনো মারাত্মক অস্ত্র ছিল না, তবুও এই সংখ্যক ড্রোন একসাথে পাঠানো একটি বার্তা দেয়। এটি ভারতের আকাশসীমার নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে এই ধরনের কর্মকাণ্ড কেবল দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়াবে না, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে তুরস্কের তৈরি ড্রোন ব্যবহারের বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে নজর কাড়বে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু বিশ্লেষক বলছেন, তুরস্ক ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা দিন দিন বাড়ছে, যা ভারতের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করছে। ভারত ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ভাগাভাগি বাড়াচ্ছে, এবং এই ঘটনার পর সেই চেষ্টাকে আরও জোরালো করা হতে পারে।

ভারতের সম্ভাব্য পদক্ষেপ

ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিষয়টি কেবল সীমান্ত সমস্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি এখন জাতীয় নিরাপত্তার কেন্দ্রে চলে এসেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারত নিজেদের বিমান প্রতিরক্ষা ও ড্রোন প্রতিরোধ প্রযুক্তি আরও উন্নত করতে উদ্যোগ নিচ্ছে।

এছাড়া, নয়াদিল্লি আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি তুলতে পারে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের পরিকল্পনা করছে। বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এই ইস্যু উত্থাপন করা হতে পারে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।

উপসংহার

এই ঘটনায় ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও উভয় পক্ষই নিজেদের অবস্থান থেকে দাবির পক্ষে বক্তব্য দিয়েছে, তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি এখন দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতির দিকে। বিশেষ করে ড্রোন প্রযুক্তির এই ব্যবহার আগামী দিনে যুদ্ধনীতি ও কূটনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button