পাকিস্তানের দাবি: ভারতের ৭৭টি ইসরায়েলি হারোপ ড্রোন ভূপাতিত

গত দুই দিনে ভারতের ৭৭টি ড্রোন ভূপাতিত করার দাবি করেছে পাকিস্তান। দেশটির নিরাপত্তা ও সামরিক সূত্রের বরাতে পাকিস্তানি গণমাধ্যম সামা টিভি জানিয়েছে, এই ড্রোনগুলো ইসরায়েল নির্মিত হারোপ মডেলের, যা লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) বরাবর সামরিক ঘাঁটি এবং বেসামরিক এলাকাকে লক্ষ্য করে প্রেরণ করা হয়েছিল। এই ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার সর্বশেষ প্রকাশ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
ড্রোন ভূপাতিতের বিস্তারিত
পাকিস্তানের নিরাপত্তা সূত্রের দাবি, ৮ মে সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৯টি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছিল। এরপর, রাতভর অভিযানে আরও ৪৮টি ড্রোন ধ্বংস করা হয়। এই ড্রোনগুলো পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন এবং নজরদারি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে জানানো হয়েছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর গণসংযোগ শাখার মহাপরিচালক (ডিজি আইএসপিআর) লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, “আমাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। প্রতিটি ড্রোন রাডারে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যখনই কোনও ড্রোন আমাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করে, তখন তা তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত ও ধ্বংস করা হয়।”
তিনি আরও জানান, বেসামরিক এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং বাণিজ্যিক বিমান চলাচলের সময় ড্রোন ভূপাতিত করার জন্য একটি কার্যকর প্রোটোকল অনুসরণ করা হয়। এই প্রোটোকলের মাধ্যমে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম (সফট-কিল) এবং অস্ত্রভিত্তিক (হার্ড-কিল) কৌশল ব্যবহার করে এই ড্রোনগুলো নিষ্ক্রিয় করেছে।
হারোপ ড্রোনের বৈশিষ্ট্য
ইসরায়েলের এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (আইএআই) নির্মিত হারোপ ড্রোন একটি অত্যাধুনিক ‘লোইটারিং মিউনিশন’ বা কামিকাজে ড্রোন। এটি ৬ থেকে ৯ ঘণ্টা পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুর উপর চক্রাকারে ঘুরতে পারে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে শত্রুপক্ষের রাডার, যোগাযোগ ব্যবস্থা বা অন্যান্য কৌশলগত স্থাপনা শনাক্ত করে আঘাত করতে সক্ষম। এই ড্রোনের সর্বোচ্চ পাল্লা প্রায় ১,০০০ কিলোমিটার, এবং এটি ২৩ কেজি উচ্চ-বিস্ফোরক ওয়ারহেড বহন করতে পারে। এর গতি ঘণ্টায় ৪৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত। হারোপ ড্রোনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এটি নিম্ন উচ্চতায় উড়ে রাডার ফাঁকি দিতে পারে, যা এটিকে বিশেষভাবে কার্যকর করে তোলে।
পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র আহমেদ শরীফ জানিয়েছেন, ভূপাতিত ড্রোনগুলোর ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে এগুলো ইসরায়েলি হারোপ মডেল। তিনি দাবি করেন, ভারত এই ড্রোনগুলো ব্যবহার করে পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনায় আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল। তবে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দক্ষতার কারণে এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে।
পটভূমি ও উত্তেজনার কারণ
এই ঘটনার পটভূমিতে রয়েছে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের কাশ্মীর সংকট। গত ২২ এপ্রিল ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পাহেলগামে একটি সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদ এবং লস্কর-ই-তৈয়বাকে দায়ী করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারত ৬ মে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে একটি অভিযান শুরু করে, যার অধীনে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। ভারত দাবি করে, এই হামলাগুলো সন্ত্রাসী অবকাঠামো ধ্বংসের জন্য পরিচালিত হয়েছিল।
অন্যদিকে, পাকিস্তান এই হামলাগুলোকে ‘উসকানিমূলক’ এবং ‘বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত’ বলে অভিহিত করেছে। পাকিস্তানের দাবি, এই হামলায় অন্তত ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৩৫ জন আহত হয়েছেন। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভারতীয় হামলায় মসজিদ ও আবাসিক ভবনের মতো বেসামরিক স্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান পাল্টা হামলার ঘোষণা দিয়েছে এবং ভারত-শাসিত কাশ্মীরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী এই ঘটনাকে ভারতের ‘নগ্ন আগ্রাসন’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ বলেন, “ভারত ইসরায়েলি প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে আমাদের উপর আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাদের এই পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়েছে।” তিনি আরও জানান, ভূপাতিত ড্রোনগুলোর ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং এগুলো আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের আগ্রাসনের প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হবে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ এই ঘটনার নিন্দা করে বলেছেন, “ভারতের এই আগ্রাসন আমাদের ভৌগোলিক অখণ্ডতার উপর আঘাত। আমরা যে কোনো মূল্যে আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করব।” তিনি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
ভারতের অবস্থান
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এখনও এই ড্রোন ভূপাতিতের দাবির বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করেনি। তবে, ভারতীয় সূত্রগুলো দাবি করেছে যে তাদের অভিযানগুলো কেবলমাত্র সন্ত্রাসী ঘাঁটি লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়েছে এবং কোনো বেসামরিক স্থাপনায় হামলা করা হয়নি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তানের অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ এবং ‘প্রচারণামূলক’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহত্তর সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করেছে। ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত রেউভেন আজার ভারতের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, “সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার অধিকার প্রতিটি দেশের রয়েছে।” অন্যদিকে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ বিন যায়েদ উভয় দেশকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো হারোপের মতো স্বয়ংক্রিয় ড্রোন ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই ড্রোনগুলো মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
উপসংহার
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনা এবং ড্রোন ভূপাতিতের ঘটনা দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের শত্রুতার একটি নতুন অধ্যায়। পাকিস্তানের দাবি এবং ভারতের নীরবতা এই সংঘাতের জটিলতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ এবং নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া এই উত্তেজনা কমার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সিগন্যালবিডি এই পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে এবং নতুন তথ্য পাওয়া মাত্রই পাঠকদের জানানো হবে।