বিশ্ব

দিল্লি স্টেডিয়ামে বিস্ফোরণের হুমকি, নিরাপত্তা শঙ্কায় এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত আইপিএল

চলমান ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) ২০২৫ আসরের মাঝপথে নিরাপত্তা উদ্বেগে থমকে দাঁড়াল ক্রিকেট-উন্মাদ ভারত। আইপিএলের ৫৮তম ম্যাচে দিল্লি ক্যাপিটালস ও পাঞ্জাব কিংসের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ খেলায় হঠাৎ নিরাপত্তাজনিত শঙ্কা দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে খেলা বন্ধ করে দেন ম্যাচ আম্পায়াররা। খেলা চলাকালীন পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জম্মু ও সীমান্তবর্তী এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই স্টেডিয়ামের পরিবেশ অস্থির হয়ে ওঠে। হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (এইচপিসিএ) স্টেডিয়ামে দ্রুত আলো নিভিয়ে খেলা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।

এর মধ্যেই পরিস্থিতি আরও জটিল হয় শুক্রবার (৯ মে) সকালে। দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে ইমেইলের মাধ্যমে আসে নতুন এক বিস্ফোরণের হুমকি। স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষ একটি বেনামি ইমেইল পায়, যেখানে বলা হয়, শিগগিরই স্টেডিয়ামটি উড়িয়ে দেওয়া হবে। ইমেইলটি পাওয়ার পরপরই দিল্লি ও জেলা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (ডিডিসিএ) বিষয়টি দিল্লি পুলিশকে জানায় এবং সঙ্গে সঙ্গে স্টেডিয়ামে শুরু হয় তল্লাশি ও নিরাপত্তা তৎপরতা।

ডিডিসিএর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে জানান, “আমরা সকালে একটি ইমেইল পাই যেখানে সরাসরি স্টেডিয়াম উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমরা পুলিশকে বিষয়টি জানাই। পুলিশ স্টেডিয়ামে এসে গোটা চত্বর তল্লাশি করে এবং বম্ব স্কোয়াড মোতায়েন করা হয়।”

স্লিপার সেল ও ‘অপারেশন সিঁদুর’

এই হুমকি বার্তায় একটি উদ্বেগজনক দাবি করা হয়—পাকিস্তান-সমর্থিত স্লিপার সেল ভারতে সক্রিয় রয়েছে এবং তারা ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে একটি পরিকল্পনার আওতায় এই বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, এই অপারেশনটি শুধু স্টেডিয়ামে নয়, ভারতের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা লক্ষ্য করে সাজানো হয়েছে।

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একাধিক রিপোর্টে এমন স্লিপার সেল বা ঘাপটি মেরে থাকা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল। তবে এই হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি আরও বেশি উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে যখন আইপিএল চলমান এবং লাখো মানুষের সরাসরি ও পরোক্ষভাবে এই খেলায় সম্পৃক্ততা রয়েছে।

আইপিএল স্থগিতের সিদ্ধান্ত

পরিস্থিতি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) অবশেষে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। এক সপ্তাহের জন্য পুরো আইপিএল স্থগিত করা হয়। বিসিসিআইয়ের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে জানান, “আমরা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করেছি। আমাদের কাছে খেলোয়াড়, দর্শক এবং সংশ্লিষ্ট সকলের নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামী এক সপ্তাহের জন্য আইপিএলের সব ম্যাচ স্থগিত থাকবে। নতুন সূচি ও ভেন্যু শিগগিরই জানানো হবে।”

এই মুহূর্তে সবচেয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ১১ মে দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে নির্ধারিত দিল্লি ক্যাপিটালস বনাম গুজরাট টাইটানসের ম্যাচটি। বিসিসিআই জানিয়েছে, ওই ম্যাচের বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি এবং গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

ক্রিকেটের মাঠে সন্ত্রাসবাদের ছায়া

ভারতের ক্রীড়াঙ্গনে নিরাপত্তা হুমকি নতুন কিছু নয়। অতীতে ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার সময় ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল ভারত সফর সংক্ষিপ্ত করেছিল। এমনকি পাকিস্তানের লাহোরে শ্রীলঙ্কান দলের ওপর হামলার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ বন্ধ রয়েছে। তবে আইপিএলের মতো উচ্চপর্যায়ের ঘরোয়া লীগে এভাবে সরাসরি বিস্ফোরণের হুমকি পাওয়া বিরল ঘটনা।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর লক্ষ্য হচ্ছে ভারতের অভ্যন্তরে অস্থিরতা সৃষ্টি করা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের ভাবমূর্তিকে আঘাত করা। ক্রীড়া আয়োজন, বিশেষ করে ক্রিকেটের মতো জনপ্রিয় খেলায় হুমকি দিয়ে তারা জনগণের মনে আতঙ্ক ছড়াতে চায়।

নিরাপত্তা ব্যবস্থার নতুন চ্যালেঞ্জ

বর্তমান পরিস্থিতিতে আইপিএল আয়োজকদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। প্রতিটি ভেন্যুতে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। অতিরিক্ত সিসিটিভি ক্যামেরা, স্ক্যানার ও সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকায় সাধারণ জনগণের চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।

ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি চালাচ্ছে এবং প্রতিটি রাজ্যের পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে নিরাপত্তা পরিকল্পনা পুনর্গঠন করা হয়েছে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) অজিত ডোভাল ব্যক্তিগতভাবে গোয়েন্দা তথ্য পর্যবেক্ষণ করছেন বলে জানা গেছে।

খেলোয়াড়দের উদ্বেগ ও ভক্তদের প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনার পর খেলোয়াড়দের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। অনেক বিদেশি খেলোয়াড় ইতিমধ্যে বিসিসিআই’র সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। একইসঙ্গে কিছু খেলোয়াড় ব্যক্তিগতভাবে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত বিবেচনা করছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।

অন্যদিকে, আইপিএলপ্রেমী লাখো দর্শকের মনেও দেখা দিয়েছে শঙ্কা। খেলা বন্ধ হওয়ায় যেমন হতাশা রয়েছে, তেমনি নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তিত তাঁরা। দিল্লির একজন দর্শক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “আমরা টিকিট কিনেছি অনেক আগেই। খেলা দেখতে গিয়েছিলাম পরিবার নিয়ে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খেলা দেখা ঠিক না।”

সামগ্রিক মূল্যায়ন

ভারতের মতো একটি বৃহৎ দেশে, যেখানে ক্রিকেট শুধুই খেলা নয় বরং এক প্রকার আবেগ, সেখানে আইপিএল-এর মত আসর নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বিষয়। এই ঘটনায় শুধু একটি খেলা নয়, ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার বাস্তবতাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এমন ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের প্রতিটি আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া টুর্নামেন্টে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ, ক্রিকেট মাঠ এখন শুধুমাত্র খেলার জায়গা নয়—এটি হয়ে উঠছে ভারতের সম্মান ও নিরাপত্তার প্রতীক।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button