বিশ্ব

জাপানের অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরে পড়লো উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র

উত্তর কোরিয়া আবারও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার মাধ্যমে। বৃহস্পতিবার (৮ মে) ভোরে দেশটি জাপান সাগরের দিকে একাধিক স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করে, যা শেষ পর্যন্ত জাপানের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের (EEZ) বাইরে গিয়ে পড়ে। জাপানের জাতীয় সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকে এই খবর নিশ্চিত করে।

ঘটনাটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিপ্রেক্ষিতে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে এবং অঞ্চলটির ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব লঙ্ঘন করে উত্তর কোরিয়ার এমন পদক্ষেপ ভবিষ্যতে আরও কঠোর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ডেকে আনতে পারে।

জাপানি প্রতিক্রিয়া: নিরাপত্তা হুমকির আশঙ্কা

জাপানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নাকাতানি গেন এক বিবৃতিতে বলেন, “উত্তর কোরিয়ার এই ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ জননিরাপত্তার জন্য এক স্পষ্ট হুমকি এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের গুরুতর লঙ্ঘন।” তিনি আরও জানান, জাপান এই ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে এবং কূটনৈতিক মাধ্যমে বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরবে।

প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোকে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে সমুদ্র ও আকাশপথে চলাচলকারী যানবাহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারেও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বলেছে টোকিও প্রশাসন।

দক্ষিণ কোরিয়ার পর্যবেক্ষণ ও তথ্য

উৎক্ষেপণের পরপরই দক্ষিণ কোরিয়ার জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ জানায়, ওনসান শহরের উপকূলবর্তী একটি অঞ্চল থেকে এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ছোঁড়া হয়। এগুলোর পরিসর ছিল স্বল্প পাল্লার, তবে সুনির্দিষ্টভাবে কোন মডেলের ক্ষেপণাস্ত্র তাৎক্ষণিকভাবে নির্ধারণ করা যায়নি।

সিউল জানায়, উত্তর কোরিয়া এই বছর বেশ কয়েকবার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে, তবে ১০ মার্চের পর এটিই ছিল তাদের প্রথম বড় ধরনের উৎক্ষেপণ। দক্ষিণ কোরিয়া বর্তমানে পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং তাদের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের অবস্থান

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বেশ কয়েকটি প্রস্তাবে উত্তর কোরিয়ার যেকোনো ধরনের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশটির পারমাণবিক কার্যক্রম ও সামরিক আগ্রাসনের কারণে ২০০৬ সাল থেকে বিভিন্ন দফায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

তবে এ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে উত্তর কোরিয়া গত কয়েক বছরে ১০০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করেছে, যার মধ্যে কয়েকটি মাঝারি এবং দীর্ঘ পাল্লার। এই পরিস্থিতি বিশ্বনেতাদের জন্য এক গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া

বিশ্লেষকদের মতে, উত্তর কোরিয়ার সাম্প্রতিক এই কার্যক্রম আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আবারও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো এ ঘটনার নিন্দা জানাতে পারে এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নতুন করে আলোচনার উদ্যোগ নিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ কোরিয়া যৌথ সামরিক মহড়া জোরদার করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এই মহড়াগুলো উত্তর কোরিয়াকে সামরিকভাবে চাপে রাখার একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

উত্তর কোরিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ও আগের ইতিহাস

উত্তর কোরিয়া বরাবরই দাবি করে আসছে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ও পরমাণু কার্যক্রম দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য অপরিহার্য। তারা যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার ‘উসকানিমূলক মহড়া’ এবং নিষেধাজ্ঞাকে আত্মরক্ষার পক্ষে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরে।

পিয়ংইয়ং এর ভাষ্যমতে, যতদিন না যুক্তরাষ্ট্র ‘শত্রুতামূলক নীতি’ পরিহার করে, ততদিন উত্তর কোরিয়া তাদের সামরিক সক্ষমতা উন্নয়ন অব্যাহত রাখবে।

নৌচলাচল ও বাণিজ্যের ওপর প্রভাব

জাপান সাগরে ক্ষেপণাস্ত্র পড়ার ফলে সাময়িকভাবে কিছু বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে প্রভাব পড়ে। তবে জাপান সরকার দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে বলে জানা গেছে।

আকাশপথে চলাচলকারী বিমান সংস্থাগুলোও সতর্কতা অবলম্বন করছে এবং কিছু রুট সাময়িকভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং পরিবহন খাত ইতোমধ্যেই এই ধরনের অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় কৌশলগত প্রস্তুতি নিচ্ছে।

সমাপনী মন্তব্য

উত্তর কোরিয়ার এই সাম্প্রতিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন দিকচিহ্ন তৈরি করেছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র—এই তিন দেশ এখন কূটনৈতিক ও সামরিক উভয় দিকেই সমন্বয় করে চলমান উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করছে।

তবে পিয়ংইয়ং যদি নিষেধাজ্ঞা বা চাপ উপেক্ষা করে এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যেতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে, যা কেবল উত্তর-পূর্ব এশিয়ার নয়, বরং গোটা বিশ্বের নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button