বিশ্ব

জম্মু-কাশ্মীরে সাইরেন ও ব্ল্যাকআউট

ভারতশাসিত জম্মু-কাশ্মীরে বৃহস্পতিবার (৮ মে) স্থানীয় সময় সকাল থেকে সাইরেনের তীব্র শব্দ এবং বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার ঘটনা ঘটেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি এবং ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জম্মু, কুপওয়াড়া, কিষ্টওয়ার, সাম্বা, উধমপুর, ফিরোজপুর, পাঠানকোট এবং আমৃতসরসহ একাধিক এলাকায় এই পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এই ঘটনার পেছনে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সামরিক উত্তেজনাকে দায়ী করা হচ্ছে, যা গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁও হামলার পর থেকে নতুন মাত্রা পেয়েছে।

ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের দাবি, বৃহস্পতিবার সকালে পাকিস্তান জম্মু-কাশ্মীর, পাঞ্জাব এবং গুজরাটের ১৫টি শহরে সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। তবে এই হামলায় কোনও হতাহত বা উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতির তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এই হামলার দায় অস্বীকার করা হয়েছে, এবং তারা দাবি করেছে যে ভারতের অভিযোগগুলো বানোয়াট।

অন্যদিকে, ভারতীয় সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, পাকিস্তানের এই হামলার জবাবে তারা একই মাত্রার পাল্টা হামলা চালিয়েছে। ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাকিস্তানের ছোড়া ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়েছে বলে এনডিটিভির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জম্মুতে একটি ড্রোন হামলার চেষ্টা ব্যর্থ করা হয়েছে বলেও দাবি করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। এই ঘটনার পর জম্মু-কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকায় স্কুল, কলেজ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

পটভূমি: পহেলগাঁও হামলা থেকে উত্তেজনার শুরু

এই সংঘাতের মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল ভারতশাসিত জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা। এই হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু পর্যটক। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তইয়বার সঙ্গে যুক্ত ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’-কে দায়ী করেছে। তবে পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং দাবি করেছে যে হামলার দায় স্বীকারের বিষয়টি স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

এই হামলার পর ভারত কঠোর কূটনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পাকিস্তানি কূটনীতিকদের বহিষ্কার করা হয় এবং সিন্ধু পানি চুক্তি বাতিলের হুমকি দেওয়া হয়। ৬ মে ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে পাকিস্তান ও পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যার লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসী অবকাঠামো ধ্বংস করা। পাকিস্তানের দাবি, এই হামলায় ৮ থেকে ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে শিশুও রয়েছে। এর জবাবে ৭ মে পাকিস্তান ভারতশাসিত কাশ্মীরে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যাতে ভারতের তিনজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন।

ব্ল্যাকআউট ও সাইরেন: জনমনে আতঙ্ক

জম্মু-কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকায় ব্ল্যাকআউট এবং সাইরেনের ঘটনা স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, মুজাফফরাবাদে ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময় মসজিদ ও শিক্ষা কমপ্লেক্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা মুহাম্মদ ইউনিস শাহ বলেন, “ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়, মানুষ নিরাপদ স্থানের খোঁজে ছুটোছুটি করছিল।”

ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৭ মে থেকে দেশের ২৪৪টি জেলায় সিভিল ডিফেন্স মক ড্রিল শুরু করেছে, যার উদ্দেশ্য যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ব্ল্যাকআউট কৌশল প্রয়োগের প্রস্তুতি। এনডিটিভি জানিয়েছে, এই ধরনের মহড়া সর্বশেষ ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় দেখা গিয়েছিল।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ

এই সংঘাতের ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়েছে। জাতিসংঘের একটি দল পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে, যেখানে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ এই উত্তেজনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে উভয় দেশকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। তুরস্ক ভারতের হামলার নিন্দা জানালেও, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনও কোনও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, তাদের অ্যাওয়াক্স সিস্টেম ভারতীয় যুদ্ধবিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র ট্র্যাক করতে সক্ষম, যা তাদের পাল্টা হামলার ক্ষেত্রে কৌশলগত সুবিধা দিচ্ছে। অন্যদিকে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। মোদি বলেছেন, “যারা এই হামলার পেছনে রয়েছে, তারা কল্পনাতীত শাস্তি পাবে।”

সম্ভাব্য পরিণতি ও ভবিষ্যৎ

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই সংঘাত বৃহত্তর কাশ্মীর সংকটের একটি অংশ। ১৯৪৭ সাল থেকে এই অঞ্চল নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ চলছে, যা একাধিক যুদ্ধ এবং সংঘর্ষের জন্ম দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ সিন্ধু নদের পানি বণ্টন চুক্তি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছেন, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, উভয় দেশের এই পাল্টাপাল্টি হামলা এবং সামরিক প্রস্তুতি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। জম্মু-কাশ্মীরে ব্ল্যাকআউট এবং সাইরেনের ঘটনা স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রাকে বিঘ্নিত করেছে এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভারতের বৃহত্তম এয়ারলাইন ১৬৫টি ফ্লাইট বাতিল করেছে, এবং সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে খাদ্য মজুতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

উপসংহার

জম্মু-কাশ্মীরে সাইরেন এবং ব্ল্যাকআউটের ঘটনা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভঙ্গুরতাকে আরও স্পষ্ট করেছে। উভয় দেশের সামরিক পদক্ষেপ এবং কূটনৈতিক উত্তেজনা দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্রুত হস্তক্ষেপ এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ ছাড়া এই সংকট আরও গভীর হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button