ইসরায়েলি হারোপ ড্রোন: পাকিস্তানে ভারতের ব্যবহৃত প্রাণঘাতী অস্ত্র

পাকিস্তানের পক্ষ থেকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিরুদ্ধে অত্যাধুনিক ইসরায়েলি হারোপ ড্রোন ব্যবহার করে হামলার গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। দেশটির সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র দাবি করেছেন যে ভারত গতকাল বুধবার রাত থেকে আজ বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত পাকিস্তানের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে একাধিক হারোপ ড্রোন নিক্ষেপ করেছে এবং এর মধ্যে অন্তত ২৫টি ড্রোন সফলভাবে ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এই ঘটনা দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশটির আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক (ডিজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ এই চাঞ্চল্যকর দাবি করেন। তিনি বলেন, গতকাল ৭ মে বুধবার দিবাগত রাত থেকে ৮ মে বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় দুপুর পর্যন্ত ভারতীয় বাহিনী এই ড্রোন হামলা চালায়। আইএসপিআর ডিজি এই ঘটনাকে আগ্রাসন হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং এর পাল্টা জবাব দেওয়ার অধিকার পাকিস্তানের রয়েছে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
হারোপ ড্রোনগুলো হলো বিশেষ ধরনের “লয়টারিং মিউনিশন” বা এক প্রকারের স্বয়ংক্রিয় আক্রমণাত্মক ড্রোন, যা শত্রুর লক্ষ্যবস্তুর উপর দীর্ঘ সময় ধরে চক্কর কাটতে পারে এবং সুযোগ বুঝে নিজে থেকেই আঘাত হানতে পারে। এগুলো ইসরায়েলের অন্যতম শীর্ষ সরকারি প্রতিরক্ষা কোম্পানি ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (আইএআই) দ্বারা নির্মিত। হারোপ ড্রোনগুলো মূলত শত্রুপক্ষের রাডার সিস্টেম, যোগাযোগ কেন্দ্র এবং এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ধ্বংস করার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। এর স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ এবং নির্ভুলভাবে আঘাত হানার ক্ষমতা এটিকে অত্যন্ত প্রাণঘাতী করে তুলেছে।
আইএসপিআর ডিজি সংবাদ সম্মেলনে হারোপ ড্রোনগুলোর কিছু প্রযুক্তিগত বিবরণও তুলে ধরেন। তার তথ্য অনুযায়ী, এই ড্রোনগুলো ১,০০০ কিলোমিটার (প্রায়) পর্যন্ত পাল্লায় কার্যকর হতে পারে, যা এটিকে সীমান্ত থেকে বহু অভ্যন্তরে থাকা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সক্ষমতা দেয়। একবার উৎক্ষেপণ করার পর হারোপ ৬ থেকে ৯ ঘন্টা পর্যন্ত টার্গেট এলাকার ওপর চক্রাকারে ঘুরে নজরদারি করতে এবং সঠিক সুযোগ বুঝে আত্মঘাতী হামলা চালাতে পারে। এর ২৩ কেজি ওজনের উচ্চ-বিস্ফোরক ওয়ারহেড যেকোনো সামরিক স্থাপনা বা লক্ষ্যবস্তুর জন্য যথেষ্ট ধ্বংসাত্মক। ড্রোনটির সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৪৬০ কিলোমিটার, যা এটিকে দ্রুততার সাথে লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছাতে বা অবস্থান পরিবর্তন করতে সহায়তা করে। হারোপ ড্রোন প্রি-প্রোগ্রাম করা টার্গেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আঘাত হানতে পারে অথবা রিয়েল-টাইমে অপারেটরের নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশে লক্ষ্য পরিবর্তন বা আক্রমণ সম্পাদন করতে পারে। শত্রুর আধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, গ্রাউন্ড রাডার স্টেশন এবং গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ কেন্দ্র ধ্বংস করার ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে পারদর্শী। একবার লঞ্চ করা হলে এটি তার নির্ধারিত টার্গেট খুঁজে বের করে ধ্বংস না করা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে যেতে পারে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক এবং সামরিক রক্ষণশীল বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হারোপ ড্রোনের মতো লয়টারিং মিউনিশন পাকিস্তানের প্রচলিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। তাদের মতে, এই ড্রোনের কিছু বৈশিষ্ট্য প্রচলিত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের জন্য মোকাবিলা করা কঠিন করে তোলে। এর মধ্যে অন্যতম হলো অত্যন্ত নিচু উচ্চতায় উড়ে যাওয়ার ক্ষমতা, যা এটিকে অনেক রাডার সিস্টেমে ধরা পড়া থেকে বাঁচিয়ে দেয়। এছাড়াও, যুদ্ধক্ষেত্রের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দ্রুত লক্ষ্যবস্তু পরিবর্তন করার ক্ষমতা এটিকে আরও অনির্দেশ্য এবং বিপজ্জনক করে তোলে। প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা যুদ্ধবিমানের জন্য এমন ছোট এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন, নিচু দিয়ে উড়ে আসা ড্রোনকে শনাক্ত করে ধ্বংস করা একটি জটিল কাজ হতে পারে।
তবে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী দৃঢ়ভাবে দাবি করেছে যে তারা এই ধরনের অত্যাধুনিক ড্রোন হামলার মোকাবিলা করতে সক্ষম। আইএসপিআর মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ বলেছেন যে পাকিস্তানের কাছে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার (Electronic Warfare – EW) সিস্টেম রয়েছে, যা দিয়ে এই ড্রোনগুলোকে শনাক্ত, জ্যাম বা নিষ্ক্রিয় করে ভূপাতিত করা সম্ভব। তার দাবি অনুযায়ী, গতকাল ও আজ ভূপাতিত করা ২৫টি ড্রোনই পাকিস্তানের ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং এয়ার ডিফেন্স সক্ষমতার প্রমাণ। ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম শত্রুর ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জাম, যেমন – ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, জিপিএস সিগন্যাল বা কমিউনিকেশন জ্যাম করে সেগুলোকে অকার্যকর করে তুলতে পারে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই দাবি যদি সত্যি হয়, তবে তা হারোপ ড্রোনের কথিত অপ্রতিরোধ্যতার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে।
ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা নতুন নয়। কাশ্মীরের মতো স্পর্শকাতর অঞ্চল নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ চলছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা দুই দেশেই বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সীমান্ত এলাকায় প্রায়শই ড্রোন অনুপ্রবেশের অভিযোগ ওঠে। তবে, এই প্রথমবার পাকিস্তান সুনির্দিষ্টভাবে ভারতের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি হারোপের মতো একটি অত্যাধুনিক আক্রমণাত্মক ড্রোন বৃহৎ সংখ্যায় ব্যবহার করার অভিযোগ আনলো এবং একই সাথে বিপুল সংখ্যক ড্রোন ভূপাতিত করার দাবি জানালো।
এই ঘটনা আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির জন্য উদ্বেগজনক। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তবে এটি ভবিষ্যতে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে উন্নত ড্রোন এবং লয়টারিং মিউনিশনের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। একই সাথে, পাকিস্তানের ২৫টি ড্রোন ভূপাতিত করার দাবি যদি সত্য হয়, তবে তা পাকিস্তানের এয়ার ডিফেন্স এবং ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সক্ষমতার একটি নতুন মাত্রা নির্দেশ করে। যদিও যুদ্ধক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা প্রায়শই কঠিন, তবুও পাকিস্তানের এই দাবি দুই দেশের সামরিক কৌশল এবং সক্ষমতা নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ভারতের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এই অভিযোগের বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে অতীতে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সীমান্ত লঙ্ঘন বা উস্কানির অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এই ঘটনার পর দুই দেশের সীমান্ত পরিস্থিতি এবং সামরিক মহড়াগুলোর উপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর থাকবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সামরিক সরঞ্জাম, বিশেষ করে ড্রোন এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্যবহার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, এই ঘটনাটি আবারও তা সামনে নিয়ে এসেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই দাবি এবং ইসরায়েলি হারোপ ড্রোনের ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত তথ্য এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।