লাহোরে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ‘অকার্যকর’ করে দেওয়া হয়েছে: দাবি ভারতের

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে লাহোরে পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দুই দেশের পাল্টাপাল্টি দাবি। ভারত সরকার বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, তাদের সামরিক অভিযানে পাকিস্তানের লাহোরে একটি আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ‘অকার্যকর’ হয়ে গেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা একাধিক স্থানে ২৫টি ভারতীয় ড্রোন নিষ্ক্রিয় করেছে এবং এই ঘটনায় একজন বেসামরিক নাগরিক নিহত ও চার সেনাসদস্য আহত হয়েছেন। দুই দেশের এই দাবি ও পাল্টা দাবি সীমান্তে উত্তেজনাকে আরও তীব্র করেছে।
ভারত সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়, “নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, লাহোরে পাকিস্তানের একটি আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে।” তবে এই হামলা কীভাবে বা কোন প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে, সে বিষয়ে ভারত কোনো বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি। ভারত আরও দাবি করেছে, পাকিস্তান গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত থেকে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর মর্টার ও শক্তিশালী কামান ব্যবহার করে গোলাবর্ষণের মাত্রা বাড়িয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরের কুপওয়ারা, বারামুল্লা, উরি, পুঞ্চ, মেন্দার এবং রাজৌরি সেক্টরে এসব হামলা চালানো হচ্ছে বলে ভারতের অভিযোগ।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, ভারতীয় ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালানোর চেষ্টা করেছে, যার মধ্যে লাহোরের ওয়ালটন রোডে একটি ড্রোন ধ্বংস করা হয়েছে। পাকিস্তানের দাবি, এই ড্রোনগুলো নজরদারি ও বিস্ফোরক বহন করছিল। ঘটনার পর নিরাপত্তা বাহিনী পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে এবং জ্যামার ব্যবহার করে ড্রোনগুলো নিষ্ক্রিয় করা হয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এই হামলায় একজন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং চার সেনাসদস্য আহত হয়েছেন। আমরা ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি।”
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে একটি সামরিক অভিযানের অধীনে পাকিস্তানের ছয়টি শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। ভারত দাবি করে, এই হামলার লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে অবস্থিত সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস করা। তবে পাকিস্তান এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, ভারত বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে, যার ফলে নারী ও শিশুসহ ৩১ জন নিহত এবং ৫৭ জন আহত হয়েছেন। ভারতের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের পাল্টা গোলাবর্ষণে ১৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৪৩ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর একজন সদস্যও নিহত হয়েছেন।
এই ঘটনার পেছনে ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল পহেলগাঁও হামলার প্রেক্ষাপট রয়েছে, যেখানে ২৮ জন বেসামরিক নাগরিক, বেশিরভাগই হিন্দু পর্যটক, নিহত হন। ভারত দাবি করে, এই হামলার পেছনে পাকিস্তানের সমর্থন ছিল, যদিও পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এই ঘটনার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা তীব্র হয়েছে। ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা, আকাশপথে বিমান চলাচল বন্ধ এবং ভিসা বাতিলের মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। পাকিস্তানও ভারতীয় জাহাজের জন্য বন্দর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন সংকটের সূচনা করতে পারে। লাহোরে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অকার্যকর হওয়ার দাবি পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তবে পাকিস্তানের দাবি, তারা ভারতের হামলার জবাব দিতে সক্ষম এবং তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এখনো কার্যকর। গত শনিবার পাকিস্তান মাঝারি পাল্লার ‘আবদালি’ ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে, যার পাল্লা ৪৫০ কিলোমিটার এবং এতে উন্নত ন্যাভিগেশন সিস্টেম রয়েছে। এই পরীক্ষা ভারতের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই উত্তেজনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস পহেলগাঁও হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং উভয় দেশকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। পাকিস্তান জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের ‘আগ্রাসী পদক্ষেপ’ নিয়ে অভিযোগ তুলেছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো তৃতীয় পক্ষ এই দাবিগুলোর স্বাধীন যাচাই করেনি।
লাহোরে ড্রোন ধ্বংসের ঘটনা স্থানীয় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ওয়ালটন রোডে বিস্ফোরণের শব্দে এলাকাবাসী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। ঘটনাস্থলে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল পৌঁছালে স্থানীয়রা তাদের পথ করে দেন। এই ঘটনা দুই দেশের মধ্যে প্রযুক্তিগত যুদ্ধের নতুন মাত্রা তুলে ধরেছে, যেখানে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে।
এই পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উভয় দেশের সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা ছাড়া এই সংকট নিরসন কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সিগন্যালবিডি এই ঘটনার পরবর্তী উন্নয়ন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং পাঠকদের সর্বশেষ তথ্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি রাখছে।